হৃদয়বিদারক হৃৎকম্পন

ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন, ডেনমার্ক ফুটবল দলের তারকা খেলোয়াড়। দীর্ঘদিন খেলছেন ইংলিশ ক্লাব টটেনহাম হটস্পার্সের হয়ে। এইতো গেল জুনে তিনি নিজ দেশের হয়ে লড়ছিলেন উয়েফা আয়োজিত ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আলোচনায় ছিলেন এরিকসেন তাঁর কার্ডিয়াক অ্যাটাকের মর্মান্তিক ঘটনাকে ঘিরে।

কি করুণ দৃশ্য! কি হৃদয়বিদারক পরিবেশ! ম্যাচের প্রথমার্ধ চলমান। ৪৩ মিনিটের মত হয়েছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকা এরিকসন পড়ে গেলেন মুখ থুবরে। আতঙ্কগ্রস্থ দুই দুলের খেলোয়াড়। মুহূর্তেই মাঠে এক হুলুস্থল শুরু হয়ে গেলো। মেডিকেল টিমের ভয়ার্ত চাহনি আর ছোটাছুটিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। সেদিনটার কথা ভুলে যাননি হয়ত সমর্থকেরা।

এমন এক ঘটনার পুনঃরাবৃত্তি ঘটেছে দিন কতক আগে। বার্সেলোনা স্ট্রাইকার কুন আগুয়েরো লা লিগায় আলভেসের সাথে খেলা ম্যাচে হঠাৎ শ্বাসপ্রশ্বাসের অস্ততি নিয়ে মাঠ ছাড়েন। পরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যায় তিনি হৃদযন্ত্রের সমস্যায় তাঁকে থাকতে হবে মাস তিনেক মাঠের বাইর।

তবে ফুটবলে এমন ঘটনা ঘটেছে বহুবার। এমন মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন ফুটবল সমর্থকেরা। আজকের তালিকাটা এমন করুণ সব ঘটনার সমন্বয়ে গড়া।

  • মার্ক ভিভিয়েন ফো (ক্যামেরুন) 

ক্যামেরুন জাতীয় দলের মধ্যমাঠের খেলোয়াড় মার্ক ভিভিয়েন ফো। তিনি তাঁর দলের সাথে ২০০৩ সালে ছিলেন ফ্রান্সের লিও শহরে। ফিফা কনফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন তিনি ঐ বছরের ২৬ জুন। ম্যাচের তখন ৭২ মিনিট। মাঠের মধ্যভাগে তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। তাঁর আশেপাশে ছিলেন না কোন খেলোয়াড়। অস্বাভাবিক এই লুটিয়ে পড়া নজরে আসতে খানিক কালক্ষেপন হয়. তবুও মাঠে উপস্থিত মেডিকেল টিম দ্রুততার সাথে তাঁর সেবাশুশ্রূষা শুরু করে দেন। তাঁকে স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে আসা হয়।

মেডিকেল টিম তাঁর হৃদযন্ত্রকে সচল করতে ৪৫ মিনিটেরও বেশি চেষ্টা করে যান। যদিও যখন তাঁকে স্টেডিয়ামের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত ভিভিয়েন ফো ছিলেন জীবিত। কিন্তু সেন্টারে আসার পরই তিনি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরপর দুইবার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট শেষে জানা যায় কার্ডিয়াক অ্যাটাকই ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ।

  • মিকলোস ফেহের  (হাঙ্গেরি)

২৫ জানুয়ারি ২০০৫। বেনফিকা ও ভিটোরিয়া ডি গুইমারেসের মধ্যকার পর্তুগিজ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ। হঠাৎ বেনফিকার স্ট্রাইকার মিকলোস ফেহের খানিক সামনের দিকে ঝুকে গেলেন। বোঝাই যাচ্ছিলো তিনি কোন এক কারণে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। খানিকবাদে তিনি পিছনের দিকে পড়ে গেলেন কিছু বুঝে ওঠার আগেই। সমস্ত খেলোয়াড়েরা দৌড়ে এলেন।

মাঠে মেডিকেল টিম ঢুকে সিপিআর দিয়ে তাৎক্ষণিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালালেন। মাঠে এম্বুলেন্স চলে এলো। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও এই স্ট্রাইকার আর ফিরে এলেন না ফুটবলের সবুজ গালিচায়। ফুটবলের পাশাপাশি বিদায় জানালেন সুন্দর পৃথিবীকেও।

  • অ্যান্টেনিও পুয়ের্তা (স্পেন)

স্পেনের ক্লাব সেভিয়া এফসির ফুলব্যাক ছিলেন অ্যান্টেনিও পুয়ের্তো। ২৫ আগস্ট ২০০৭ সালে গেটাফের বিপক্ষের এক ম্যাচে হঠাৎ পেনাল্টি এরিয়ার ভেতরে লুটিয়ে পড়েন। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তিনি হেঁটে ড্রেসিং রুম পর্যন্ত পৌছালেও পরবর্তীতে জ্ঞান হারান তিনি।

মাঠে থাকা মেডিকেল টিম সিপিআর দিয়ে দ্রুত তাঁকে হসপিটালে স্থানান্তর করেন। তাঁকে আইসিউতে নিবিড় পরিচর্যায় তিন দিন থেকে ২৮ আগস্ট পরোলোক গমন করেন স্পেনের এই ডিফেন্ডার। তাঁরা বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গ হ্যাট অ্যাটাকের দরুণ কার্যক্ষমতা হারালে তিনি ধীরেধীরে ধাবিত হন মৃত্যুর দিকে।

  • ব্রুনো বোবান (ক্রোয়েশিয়া)

ক্রোয়েশিয়ান থার্ড ডিভিশনের ক্লাব মারসোনিয়ার আক্রমণভাগের খেলোয়াড় ব্রুনো বোবান। ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ স্লাভোনিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে প্রতিপক্ষ এক খেলোয়াড়ে জোড়ালো শট বুকে গিয়ে আঘাত করে বোবানের। ম্যাচের তখন কেবল পনেরো মিনিট চলমান।

খেলা চলতে থাকে। কিন্তু খেলার চলার মাঝে বোবান অজ্ঞান হয়ে মাঠে পড়ে যান। খেলোয়াড় থেকে মেডিকেল কর্মীদের ছোটাছুটি এবং প্রাথমিক চিকিৎসা চলমান থাকতেই তাঁকে এম্বুলেন্সযোগে নেওয়া হয় হাসপাতালে। তবে তাঁকে আর শেষমেশ বাঁচানো যায়নি। সজোরে বল লাগায় তাঁর হৃদস্পন্দের ব্যাঘাত ঘটে যার ফলস্বরুপ হার্টঅ্যাটাক থেকে মৃত্যুবরণ করেন ২৫ বছর বয়সী থার্ড ডিভিশনের এই সর্বোচ্চ গোলদাতা।

  • ফেব্রিস মুয়াম্বা (ইংল্যান্ড)

২০১২ সালে ইংলিশ ফুটবলার ফেব্রিস মুয়াম্বা মাঠেই হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। এফ এ কাপে বোল্টন ও টটেনহাম হটসস্পার্সের মধ্যকার ম্যাচে এমন ঘটনা ঘটে। তাঁর হৃদস্পন্দন প্রায় ৭৮ মিনিটের মত স্তব্ধ থাকলেও অলৌকিকভাবে তিনি মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসেন। পরবর্তীতের চিকিৎসকদের পরামর্শ মোতাবেক তিনি ফুটবল থেকে অবসর নেন।

  • ইকার ক্যাসিয়াস (স্পেন)

রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি ইকার ক্যাসিয়াস ২০১৯ সালে ১ মে মৌসুম পূর্ববর্তী অনুশীলনে হার্টঅ্যাটাক করেন। সেই মৌসুমে তিনি পর্তুগালের ক্লাব এফসি পোর্তোর হয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত থাকাকালীন এমন ঘটনার সম্মুখীন হন। পরবর্তীতে তাঁকে অতিদ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং তিনি চিকিৎসা শেষে মাঠে ফিরতে চাইলেও চিকিৎসকদের পরামর্শে ফুটবল ত্যাগ করেন স্পেনের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ী এই গোলরক্ষক।

এমন আরো অজানা ঘটনা হয়ত হরহামেশাই ঘটে চলেছে ফুটবল অঙ্গনে। আমরা হয়ত কিছু কিছু ঘটনার কথা জানতে পারি কিছু ঘটনা থেকে যায় পর্দার আড়ালেই। তবে সবাই প্রত্যাশা হয়ত এতটুকুই থাকে জনপ্রিয় এই খেলার মাঠে না ঘটুক আর এমন মর্মান্তিক ঘটনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link