প্রিয় রাহুল,
এই চিঠি কোনো দিনই ফিফ্থ ক্রস, থারটিনথ মেইন ইন্দিরা নগর রোড, ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছবে না জেনেও লেখা । যদি পৌঁছে যেত ও কোনো ভাবে, তাহলেও সমস্যা ছিল। কারণ ভারতীয় অনেক গুলো ভাষায় আপনি পারদর্শী হলেও বাংলা টা কি তেমন জানা আছে আপনার? জানি না!
ওপরের যে ঠিকানাটা লিখলাম সেটা আপনার স্থায়ী ঠিকানা হলেও আপনার ক্রিকেটীয় ঠিকানা আর কিছু দিন পর থেকেই বদলে যাবে। এতদিন সেটা ছিল এনসিএ, ব্যাঙ্গালুরু আর এখন থেকে আপনার ঠিকানা, ভারতীয় সিনিয়র, পুরুষ দলের ড্রেসিং রুম। এতদিন কিছু ধোঁয়াশা থাকলেও এখন এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে, আপনিই রবি শাস্ত্রীর জায়গায় বসছেন। অফিশিয়ালি যে প্রতিক্রিয়া আপনি দিয়েছেন, যা সংবাদ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে টিপিক্যাল দ্রাবিড়ীয় প্রতিক্রিয়া। তাতে আবেগের ছিটেফোঁটাও নেই! পূর্বসূরীর কাজের জন্য প্রশংসা আর শ্রদ্ধা আছে আর আছে নিজের জন্য আশাবাদ।
আপনাকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ক্রিকেট অনুরাগীদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখছি সেখানেই আপনার জন্য চিন্তা ও বাড়ছে রাহুল। সে কথায় পরে আসবো কিন্তু তার আগে আপনাকে একটা গল্প বলি। সেই গল্প শুনতে গেলে অনেক গুলো বছর পিছিয়ে যেতে হবে আমাদের। বেহালার বীরেন রায় রোডের বাসিন্দা তখন ভারতীয় দলের অধিনায়ক এবং আপনি তাঁর ডেপুটি।
এক জনপ্রিয় বাংলা কাগজের নামী সাংবাদিকের সৌজন্যে আপনি তখন বাঙালিদের কাছে হিন্দি সিনেমার অজিত বা প্রেম চোপড়ার সমগোত্রীয় ভিলেন প্রায়! এতদিন বাদে বাঙালি তার অতৃপ্ত ক্রিকেট আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার সু্যোগ পেয়েছে এবং চেটেপুটে তা করছে ও। এবং সেই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হবার পথে বাঙালির এক এবং একমাত্র বাধা তখন আপনি। ওই যে বললাম ওই সাংবাদিক খুব সফল ভাবে আপনার প্রতি একটা বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন , হয়তো তিনি ও কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করেননি।
কিন্তু এইরকম চিন্তা ভাবনায় যতটা গ্যাদগ্যাদে আবেগ ছিল, তত যুক্তি ছিল না। এবং আরো একটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি যে আমিও ওই দলে ছিলাম। রাহুল দ্রাবিড় তখন আমাদের কাছে ভিলেন ! ওওও রাহুল ! ওর তো ক্রিকেট এ মন নেই , ওর শুধু লক্ষ্য কি করে সৌরভকে হটিয়ে অধিনায়ক হওয়া যায় – এই ছিল বাঙালির জাতীয় চিন্তা ভাবনা তখন! এবং একটা পর্যায়ে এসে সেই চিন্তা বাস্তব রুপ পেল!
ব্যাস, আমাদের ক্ষোভের আগুন তখন আরো দাউদাউ!
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক অনেক জল বয়ে গেছে এবং কাবেরী দিয়েও। আপনার সঙ্গে এক ই বছরে জন্মানো আমার বয়স বেড়েছে এখন। সেই আবেগের জায়গায় যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারার ক্ষমতা এসেছে। এবং সেই জন্যই চিন্তা টা বাড়ছে। রাহুল দ্রাবিড় ভারতের কোচ হলেই সব সমস্যার সমাধান – এই জাতীয় আবেগটাই ভাবাচ্ছে। তার থেকেও ভাবাচ্ছে আরো একটা জিনিস , তা হল আপনি রাজি হলেন কেন?
কালই স্টার স্পোর্টসের কমেন্ট্রি তে হরভজন সিং বলছিলেন , রাহুল দ্রাবিড়ের কাছে ক্রিকেট মানে, ইটস্ অল অ্যাবাউট প্রিপারেশনস। রাহুল দ্রাবিড় কিছু করতে আসবেন মানে দুশো শতাংশ প্রস্তুতি নিয়েই আসবেন। ভাজ্জি আপনাকে দীর্ঘ দিন কাছ থেকে দেখেছেন। জানেন খুব ভালো করে। আর এখানেই খটকা টা লাগছে। আপনি কি সত্যিই প্রস্তুত ছিলেন বা আছেন ? নামটা রাহুল দ্রাবিড় বলেই আশা করতে ইচ্ছা করছে যে আপনি সব রকমের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন।
তাও যদি হয়, তাহলেও আপনার কাজটা যে বেশ , বেশ শক্ত তা আপনিও বিলক্ষণ জানেন। আপনি , আপনারা যে সময়ে ক্রিকেট খেলেছেন তার থেকে আরো বেশ কিছুটা বদলেছে ক্রিকেট । কিছু দিন আগেই বোধহয় বারো হাজার ছশো কোটি টাকায় ( ভুল বললে ঠিক করে দেবেন কেউ। শ বা হাজার এ চলাফেরা তো কোটি টোটি তে ঘাবড়ে যাই ) আই পি এলের দুটো নতুন দল বিক্রি হল। এটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই উল্লেখ করলাম ক্রিকেট এ কতটা টাকা এসেছে তা বোঝাবার জন্য । আর টাকার সাথে , সাথেই এসেছে এক ধরনের নতুন কালচার যা আপনার সময়ে তেমন ছিল না।
এতদিন আপনার কাজটা ছিল অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের নিয়ে , পৃথ্বী , ঋষাভ , স্যামসন – এদের কাছে আপনি রাহুল স্যার , পরম শ্রদ্ধার এক জীবন্ত বিগ্রহ। কিন্তু, এখন যাদের কোচ হলেন তাদের পকেটে হাজার , হাজার টেস্ট বা ওয়ান ডে রান। বাইরে থেকে আপনার জন্য শ্রদ্ধা এবং সম্মান থাকবে অবশ্যই কিন্তু ভিতরে , ভিতরে ও অনেক খেলা চলবে। অনিল কুম্বলে নামের ভদ্রলোকের ক্রিকেট পরিসংখ্যানও নেহাৎ ফেলে দেবার মত ছিল না এবং ক্রিকেট বোধও। কিন্তু তাঁকে সরে যেতে হয়েছিল!
রঞ্জি ট্রফি আবার কবে শুরু করা যাবে সেটা অনিশ্চিত, ঘরোয়া পর্যায়ে যে ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে আবার সদ্যই , তা মুশতাক আলী ট্রফি, মানে সেই টি-টোয়েন্টি! আর বাকি ভারতীয় ক্রিকেট মানেই , ইটস অল অ্যাবাউট আইপিএল। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজটা কঠিন লাগছে। বিশেষ করে আপনি যে দলটাকে পেতে যাচ্ছেন তারা সম্ভবত টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায় নেবে। টুর্নামেন্টের হট ফেভারিটদের জন্য যেটা অতি হতাশার! মানে , প্লেয়ারদের আত্মবিশ্বাস তলানির দিকেই থাকবে। আরো চিন্তার যেটা, আপনাকে যে সময় টা দেওয়া হয়েছে সেটাও খুব বেশি নয়।
কপালে ভাঁজ ফেলার মত আরো অনেক কিছু ই আছে কিন্তু নামটা রাহুল দ্রাবিড় বলেই আশা করতে খুব ইচ্ছা করছে । ক্রিকেট জীবনে বারবার ই প্রচারের আলো কেড়ে নিয়ে গেছে অন্যরা। আপনি , রাহুল দ্রাবিড় বরাবর ই কাব্যে উপেক্ষিত এবং এখনো হয়তো আপনি সাফল্য পেলে, ‘সৌরভের মাস্টার স্ট্রোক টা দেখলে! যাবার আগে দ্রাবিড়কে কোচ করে চলে গেল! আহা কী মাথা!’
বলবার জন্য মুখিয়ে থাকা লোকের অভাব নেই। কিন্তু, আপনি রাহুল দ্রাবিড় এক ই রকম নৈর্ব্যক্তিক থেকে কাজটা করবেন জানি , শুধু নিজের কাজটা! আপনার ফিলোজফি ই তো এই – নিজের কাজটা করো দুশো শতাংশ ডেডিকেশন দিয়ে , বাকি কোনো কিছু বদলাবার দায় তোমার নয় আর সে ক্ষমতাও তোমার নেই।
অনেক , অনেক শুভকামনা রাহুল। আপনার অন্ধ ভক্ত হয়তো আমি নয় কিন্তু রোজকার জীবনে আপনার ওই ফিলোজফি মেনে চলার চেষ্টা করি। পারি না , কিন্তু চেষ্টা টা ছাড়ি নি। আপনার হাত ধরে সাফল্য কতটা আসবে জানিনা কিন্তু কিছু সংস্কার আসুক অন্তত এমন আশা করব। কিছু কিছু পরিশোধন এবং পরিমার্জনা বোধহয় প্রয়োজনীয়, খুবই ।
আবার ও বলছি অনেক অনেক শুভকামনা।