শুরু করি দল নির্বাচন থেকেই। দল নির্বাচনের সময় দেখা গিয়েছিল যে তিন পেসার একজন আধা ফিট অলরাউন্ডার এবং পাঁচ স্পিনার। মনে হয়েছিল আমিরশাহীর ধীরগতির পিচের জন্য এই সিদ্ধান্ত। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে নেওয়া হয়েছে পাওয়ার প্লে এবং স্লগে বল করতে পারবেন বলে। ধীর গতির উইকেটে বল যেখানে বেশি স্পিন করছে না সেখানে চাহলের গুগলি সকলে পড়ে ফেলছেন, তাই রাহুল চাহর, যিনি একটু জোরের উপর বল করেন। রবীন্দ্র জাদেজা মূলত অলরাউন্ডার, তাঁর ব্যাকআপ হিসাবে অক্ষর আর মিস্ট্রি বোলার হিসাবে একেবারে আনকোরা বরুণ চক্রবর্তী।
পেস বোলিং ডিপার্ট্মেন্টেও যে হেতু মাত্র তিন স্পেশালিস্ট তাই হয়তো ভুবি খেলবেনই এবং সঙ্গে বুমরাহ এবং বুমরাহ-র ব্যাকআপ হিসাবে শামি। ব্যাটিং লাইনআপে তিনজন ওপেনার, একজন আধা-ওপেনার এবং অধিনায়ক, একটা জেনুইন মিডল অর্ডার ব্যাট এবং ব্যাটসম্যান উইকেট কীপার।
বেশ কথা। আমিরশাহীর কথা চিন্তা করে দল তৈরি হল। আইপিএলের দ্বিতীয় পর্বকে আমিরশাহীতে নিয়ে যাওয়া হল। বেশ কথা। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল রোহিত শর্মা, ঈশান কিষাণ এবং এসকেওয়াই ফর্মে নেই। বিরাটের সেই ফ্রি ফ্লোইং খেলা উধাও। ভুবিও ফর্মে নেই, পন্থের বড় রান নেই এবং সবথেকে বড় কথা আপনার একনম্বর পাওয়ার হিটার এবং ম্যাচ উইনার বল করতেই পারছেন না এবং ব্যাটেও ফর্মে নেই। দুনম্বরের আবার বলই জায়গায় পড়ছে না। পাণ্ড্যা আর জাদেজা আর কি!
আপনি দল নির্বাচন করেছিলেন এই শর্তে যে ১০ই অক্টোবরের মধ্যে নাকি ফাইনাল দল নির্বাচন করতে হবে। পাকিস্তান যার সুযোগ নিয়ে শোয়েব মালিক, মোহাম্মদ হাফিজ আর ফখর জামানকে দলে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। বেশ কথা।
কিন্তু কোথাও যেন মনে হল নির্বাচন কমিটি এবং দল পরিচালন সমিতি একই পাতায় নেই। মহেন্দ্র সিং ধোনিকে জুড়ে দেওয়া হল দলের সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসাবে, কারণ তিনি নাকি স্পিন বোলিং-এ দেশের সেরা ক্যাপটেন। বেশ কথা। তবু একটা ভারসাম্যের অভাব দেখা দিচ্ছিল। উঠছিল অনেকের নাম কিন্তু আপনি টিম ম্যানেজমেন্টের আবদারে অক্ষর প্যাটেলের জায়গায় শার্দূল ঠাকুরকে ঢুকিয়ে কিছুটা ম্যানেজ করলেন। তবু স্পিন ভারি দল। যেখানে যে কোনও বোলিং লাইন আপে মূলত তিন পেসার এবং দুই স্পিনার থাকে সেখানে মোট চারজন জোরে বোলার এবং চারজন স্পিনার। হার্দিক কবে বোলিং করবেন কেউ জানেন না।
এই অবস্থায় দল মাঠে নামল। দুটো প্রস্তুতি ম্যাচে আপনার দল দারুণ পারফর্ম করল। আপনি দেখলেন ঈশান এবং সূর্য দাঁড়িয়ে গেছে। এখন বিরাট এবং রোহিত রান পেলেই হল।
পাকিস্তান ম্যাচ। ভুলে গেলেন আপনি দু মাস আইপিএল খেললেও দুবাইয়ের মাঠ পাকিস্তানের হোম গ্রাউন্ড গত পাঁচ ছ’বছর ধরে। ভুলে গেলেন যে টেপ বলে আঙুলের কারিকুরিতে মিস্ট্রি স্পিন করা বোলার পাকিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় পাওয়া যায়। এবং যে হেতু আপনি বিশ্বকাপে কখনই পাকিস্তানের কাছে হারেননি তাই খুব সিরিয়াসলি নিলেন না। টিম টস হারল এবং শাহিন আফ্রিদি বল ভিতরের দিকে আনা শুরু করলেন।
ফর্মে থাকা লোকেশ রাহুল এবং ফর্ম খোঁজা রোহিত আউট। অধিনায়ক এলেন অ্যাঙ্করিং করে পঞ্চাশ করলেন। কিন্তু মিডল ওভারে আর আগের মতো মসৃণ খেলতে পারলেন না। দরকারের সময়ে সেট হয়েও ঋষাভ আউট হলেন। হার্দিকের কথা তো ছেড়েই দিলাম। বোলিং-এর সময়ও আপনি নামতে শুরু করলেন সেই প্রথাগত তিন পেসার দুই স্পিনারে। অর্থাৎ, নির্বাচকদের টেমপ্লেটের সঙ্গে আপনারটা মিলল না। বরুণ কিছু করতে পারলেন না এবং বর্তমানে ঠিক যেভাবে টি-টোয়েন্টি খেলা উচিত, বল বিশেষ নষ্ট না করে ক্রিকেটীয় শটের উপর মূলত ভিত্তি করে রিজওয়ান-বাবর আজমরা ম্যাচ নিয়ে চলে গেল।
নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সূর্যের চোট, ঈশান এলেন ওপেন করলেন কিন্তু সেই বাঁ হাতি পেসার যিনি ভিতরে বল ঢোকান। তার সঙ্গে ঈশ সোধি, যাঁর হাই আর্ম অ্যাকশনে বল খুব একটা লেগ স্পিন না করলেও গুগলিটা মন্দ না, এবং মিচেল সান্তনার পুরোপুরি আপনাদের বেধে ফেললেন। তার সঙ্গে টসে হেরে পরে বল করার চাপে আপনি কুড়ি রান বেশি করতে গিয়ে ডুবলেন। বোলিং-এর সময় চাপই তৈরি হল না। দুটো ভাইটাল ম্যাচ হেরে গেলেন।
খেলাটা ওখানেই শেষ। দলের ক্ষেত্রে এটা অভিষেক প্রথমে বলেছিলেন, অভিষেক মুখার্জি। এবং আমিও বহুদিন ধরেই সমর্থন করছি, টি-টোয়েন্টির ক্ষেত্রে এতোগুলো অ্যাঙ্কর দিয়ে জাহাজ তরতর করে চলবে না। এটা এক বছর আগে বলেছিলাম, রোহিত, বিরাট এবং রাহুলের মধ্যে একজনকে বেছে নেবার কথা। রোহিতের হাতে বড় শট আছে, ফর্মে থাকলে প্রথম দিকে ঢিমেতালে চললেও ম্যানেজ করে ফেলবেন।
রাহুল বেশ কিছুদিন ধরেই টি-টোয়েন্টির সেরা ব্যাট ভারতের। কিন্তু বিরাট? বিরাট এই প্রজন্মের লেজেন্ড। সবরকম ফরম্যাটে তিনি বোধহয় গত দশ বছরের সেরা। কিন্তু বর্তমানে টেস্টই হোক বা ৫০ ওভার, সেই রোলস রয়েসের গতি কাজ করছে না। টেকনিকাল সমস্যা? অধিনায়কত্বের চাপ? বিশেষজ্ঞরা বলবেন। কিন্তু এফোর্টলেসলি ক্রিকেটীয় শট খেলেই যিনি বল মাঠের বাইরে অহরহ পাঠাতেই সেই মসৃণতা তাঁর ক্রিকেট থেকে গায়েব। টি২০তে ছাড়ছেন, সঙ্গে ৫০ ওভারের অধিনায়কত্ব ছাড়লেও হয়তো ভালো কাজ করবেন।
আইডিয়ালি তিনটে ফরম্যাটে তিনটে অধিনায়ক হলেই ভালো হত, টেস্টে বিরাট ভারতের সেরা অধিনায়ক। বিশেষত বাইরে। সীমিত ওভারে আবার রোহিতের চটজলদি সিদ্ধান্ত অনেক বেশি কার্যকর। বেশিদূর যেতে হবে না, আইপিএলই দেখুন। এবং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রোহিতের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার জোরে গত কয়েকবছরে পাঁচবার আইপিএল জেতা হয়ে গেছে মুম্বাইয়ের।
আরেহ আইপিএলকে ছোটো করবেন না। যে পরিমাণ এক্সপোজার নবীন ক্রিকেটাররা আইপিএলে পান, ম্যাচ সিচুয়েশন বলুন আন্তর্জাতিক মানের বোলিং বা ব্যাটিং-এর বিরুদ্ধে খেলাই বলুন এবং ততসম্পর্কিত কনফিডেন্সই বলুন, আইপিএল আছে বলেই সম্ভব হচ্ছে। ওই সব টাকা রোজগার গ্ল্যামার ইত্যাদি নোংরা কাগজের ঝুরিতে ফেলে দিন।
শুরুর দিকে সমস্যা হতেও পারত, কিন্তু এখন প্রতিটি ক্রিকেটারকে রীতিমতো ক্লাস করানো হয়, গ্ল্যামার বা মিডিয়া হ্যান্ডল করার জন্য। আইপিএল খেলে জলে যাওয়া আর আইপিএল থেকে উঠে আসা ক্রিকেটারদের সংখ্যাটা পাশাপাশি রাখুন, বুঝবেন। আর টাকা? স্যার একটা ক্রিকেটারের পেশাদারী যাপন ৩৫-৩৬ বছর পর্যন্ত। তারপর না খেতে পেয়ে মরলে তো আপনি দেখবেন না, অতএব।
সে যাক প্রচুর জ্ঞান দিয়ে ফেললাম। আমি আমার সীমিত ক্ষমতায় গলদগুলো ধরার চেষ্টা করেছি, এখন দ্রাবিড় থাকবেন বিরাট থাকবেন রোহিত অথবা রাহুল থাকবেন। তাঁরা আমার থেকে ক্রিকেটটা অনেক অনেক অনেক বেশি ভালো বোঝেন। সামলে নেবেন। তবে নির্বাচকদের কার্যকলাপ দেখে সেটা বলতে পারছি না। এর থেকে এমএসকে প্রসাদরা অনেক বেশি ভালো করে সামলেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া ট্যুরকে টেমপ্লেট করতে হবে না, কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও মাত্র মিনিট বিশেকের বাজে খেলা সব কিছুতে জল ফেলে দিয়েছিল। সে যাক।
এই নিয়েও কিন্তু টস বা কপাল একটু অনুকূলে থাকলে ভারত ফাইনালে চলে যেতে পারতো। এই ইংল্যন্ডে স্পিন খেলার একমাত্র ইয়ন মরগ্যান ও মঈন আলী এবং তার মধ্যে মরগান খুব ফর্মে নেই। বাট কিন্তু কপাল নাই থাকতে পারে, আর আইসিসি ট্রফি আপনার দেরাজে সেই ২০১৪ থেকে নেই। চোকারের তকমাটা ধীরে ধীরে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সরে আপনার দলের গায়ে লেগে যাচ্ছে। কিছু একটা করতেই হবে!
টেস্ট মেসটা বা নিদেন পক্ষে পরের টি-টোয়েন্টিটা অস্ট্রেলিয়ায় পরের বছরই। ৫০ ওভার নিয়ে এখুনি বাজি রাখতে পারছি না। ইংল্যন্ড অনেকটাই এগিয়ে বলে। তবে একটু স্মার্ট খেললে টি-টোয়েন্টিটা আনাই যাবে। টেমপ্লেট পালটে যাচ্ছে শর্টেস্ট ফরম্যাটের খেলাটার। ডট বলের উপর সব নির্ভর করছে। যেমন ব্যাটিং-এ খেলা চলবে না তেমনই বোলিং-এর সময় ডট বলই চাপ ফেলবে। আপনার দলে কৃপণতম বোলার কারা এবং কারা প্রয়োজনে টুথপিক দিয়ে ফিল্ডিং-এর ফাঁকফোকর খুঁজে নিতে পারবে বেছে নিন। তাহলেই পরের বিশ্বকাপটা আপনার।
পুনশ্চ: রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে এখুনি উচ্ছ্বসিত হচ্ছি না। কারণ উনি জুনিয়রদের নিয়ে খুব ভালো কাজ করেছেন। সিনিয়রদের নিয়ে কেমন করেন দেখা যাক। আর যতই বিরাট কোহলিকে গালাগাল দিন, যে কোনও দিন যে কোনও ক্রিকেট দলটা অধিনায়কেরই হয়। তাঁরই নেতৃত্বে মাঠে নেমে খেলে দল, আর গত কয়েক বছরে বোধহয় ছেলেটা খুব খারাপ কিছু করেনি। ভারতের অধিনায়কত্ব আর রয়াল চ্যালেঞ্জার্সের অধিনায়কত্ব এক জিনিস নয় কিন্তু।