সব কান্নার আওয়াজ নেই

বালক বয়সে প্রথম যখন দেখেছিলাম, তখনই সাধক বলে মনে হয়েছিলো।

এখনকার মত মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ ছিলো না। কিন্তু এই নির্লিপ্ত হাসি এবং ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিটা ছিলো। তিনি সবকিছুতে হাসতে পারেন। ব্যক্তিগত সাফল্য-ব্যর্থতা-দলীয় সাফল্য ব্যর্থতায় কখনোই মুখের হাসিটা নিভে যায় না। কখনোই মচকে যেতে শেখেননি যেন।

মানুষটার মুখ সেদিন একটু সময়ের জন্য ম্লান হয়ে গেল। যেন চিরকালের ধ্যানস্ত ঋষির মুখ ফুড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো একজন আবেগী মানুষ। না, শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিলেন। সকলের সামনে এসে আবার সেই চিরচেনা হাসিটা উপহার দিলেন। কান্না ঢেকে ফেললেন এক পলকে।

না, কান্না লুকাবেন না, প্রিয় কেন উইলিয়ামসন। দিনটা ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল, ২০২১। আরেকবার নিউজিল্যান্ড ও কেন উইলিয়ামসনের শূন্য হাতে ফেরার দিন।

মনে মনে অনেক কেঁদেছেন। আপনার প্রাপ্য আপনার কাছ থেকে বারবার ছিনতাই হয়েছে। আপনি মনের কান্না লুকিয়ে ফেলেছেন। এবার অন্তত কান্নাটা প্রকাশ্যে আনুন। দুনিয়া জানুক, কী এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে আপনার ওপর দিয়ে। কী এক তীরে নৌকাডুবির ফেরে পড়েছেন আপনি। বারবার আপনারই ভাগ্য আপনাকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। এক ইঞ্চির জন্য সর্বকালের সেরা হয়ে উঠতে পারছেন না প্রিয় কেন উইলিয়ামসন।

উইলিয়ামসন যখন নিতান্ত শিশু, তখনর মার্টিন ক্রো বলেছিলেন, এই নিউজিল্যান্ডে তাকে ছাড়িয়ে একদিন সর্বকালের সেরা হয়ে উঠবেন এই বালক। অনূর্ধ্ব ১৯ বা এসব পর্যায়ে খুব বলার মতো কোনো কিছু ছিল না তাঁর। তারপরও তাকে যারা একবার দেখেছেন, তারা জানতেন, এই ছেলেটির সাধনা তাকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাবে।

কেন নিজে অবশ্য নিজেকে নিয়ে সবসময় একটু কমিয়ে বলতে পছন্দ করেন। একবার বলছিলেন, ‘সবাই তো স্রষ্ঠাপ্রদত্ত হয়; কেউ কেউ বেশি পায়। তবে আমি সেরকম প্রতিভা নই।

আহ!

অথচ সেই ছেলেটিই ২০ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি করে এবং চার বছরের মধ্যে কনিষ্ঠতম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৩ হাজার রান করে ফেলে! স্যার ড ব্র্যাডম্যানকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তখন।

কার্যত জাতীয় দলের হয়ে খেলা শুরু করার পর আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দ্রুতই সময়ের সেরাদের একজন হয়ে উঠেছেন। একে একে নিউজিল্যান্ডের এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠদের কাতারে চলে এসেছেন। কিন্তু ভাগ্যের একটু ছোঁয়া যেন বাকি থেকে যায় তার বেলায়।

ব্যক্তিগত অর্জনের শেষ নেই। এক নম্বর ব্যাটসম্যান হয়েছেন, সেরা রেটিং পয়েন্ট পেয়েছেন। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে ট্রফিটাই অধরা থেকে যায়।

২০১৫ বিশ্বকাপে দলের একজন হিসেবে ফাইনালে হার দেখেছেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে জয়ের জন্য যা যা দরকার, তা করেছিলেন। ফাইনালে মূল ম্যাচ টাই করেছেন, সুপার ওভার টাই করেছেন। তারপরও বাউন্ডারির হিসেবে ট্রফি পাননি।

অবশেষে এই বছর খরাটা কেটেছে বলে মনে হচ্ছিলো। ২০২১ সালে ভারতকে হারিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে শেষ হাসিটা হেসেছিলেন উইলিয়ামসন। কিন্তু বছরের শেষে আরব আমিরাতে আবার ফিরে এলো সেই দু:স্বপ্ন।

আবার অস্ট্রেলিয়া, আবার ফাইনাল এবং আবার রানার্সআপ।

অথচ কী করেননি উইলিয়ামসন? যখন উইকেটে এলেন, কোনো আশা ভরসা ছিলো না। ৪ ওভারে ২৮ রানে ১ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিলো দল। উইলিয়ামসনকে নিয়েও খুব ভরসা ছিলো না।

এই টুর্নামেন্ট খুব ভালো যাচ্ছিলো না। ১০০-এর নিচে স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন ফাইনালের আগ পর্যন্ত। শুরুতে তেমনই আঁটোসাঁটো ছিলেন। প্রথম ১০ ওভারে ১ উইকেটে তাই ৫৭ রান উঠলো মাত্র। উইলিয়ামসন ১৯ বলে ১৮। পরের ওভারে একটা লাইফ পেলেন। আর ওখান থেকেই পাল্টা আক্রমণের এক অনন্য নজির গড়লেন।

পরের ২৯ বলে ৬৭ রান করলেন এই ধ্যান ভেঙে ওঠা ঋষি।

তার কাজটা করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়াকেও লাগাম দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু পারলেন না। ওয়ার্নার, মার্শদের বীরত্বের কাছে আরও একবার ট্রাজেডির নায়ক হয়ে রইলেন উইলিয়ামসন। আরও একবার ট্রফি ছেড়ে হৃদয় জিতে নিলেন।

কিন্তু এভাবে আর কত? আর কত হৃদয় ভেঙে হৃদয় জেতার গল্প? এবার চিৎকার করে কেঁদে অচলায়তন ভেঙে দিন, উইলিয়ামসন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link