দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ওয়াল

শচীন কিংবা লারার মত ন্যাচারালি গিফটেড ছিলেন না তিনি। অরবিন্দ ডি সিলভা কিংবা রিকি পন্টিংয়ের মত সহজাত স্ট্রোকমেকারও তাঁকে বলা যায় না। তবে টেকনিকের বিশুদ্ধতা ও ক্ল্যাসিকাল ব্যাটিংয়ের দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন ‘পারফেকশনিস্ট’। অদম্য ইচ্ছাশক্তি, নিবিড় অনুশীলন, নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদন আর সীমাহীন অধ্যবসায়ের গুণেই নিজের টেকনিক্যাল সামর্থ্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই একটা জায়গায় তিনি ছিলেন অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা, একটু অন্য রকম।

আপনারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন কার কথা বলা হচ্ছে। তিনি আধুনিক ক্রিকেটের একজন গ্রেট; ‘মি. ডিপেন্ডেবল’ খ্যাত সাবেক ভারতীয় ব্যাটিং কিংবদন্তি রাহুল দ্রাবিড়।

দ্রাবিড় ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একজন ধ্রুপদী ব্যাটসম্যান। কোচিং ম্যানুয়ালে একেকটা শট যেভাবে খেলতে বলা আছে, ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের একনিষ্ঠ অনুসারী দ্রাবিড় ঠিক সেভাবেই খেলেছেন। তাঁর ছিল রক সলিড টেম্পারমেন্ট, জমাট ডিফেন্স, গভীর মন:সংযোগ আর ইস্পাত দৃঢ় মানসিকতা। যে কারণে ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি অনায়াসে উইকেটে পড়ে থাকতে পারতেন ধৈর্য্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে। ক্রিজে একবার সেট হয়ে গেলে তাঁকে আউট করাটা ছিল রীতিমত দু:সাধ্য। উইকেটে টিকে থাকার লড়াইয়ে তিনি যেমন সংযম প্রদর্শন করতেন, তাঁকে আউট করতে গিয়ে বোলারদেরও ঠিক তেমনি ধৈর্য্যের চরম পরীক্ষা দিতে হত। আবার অতিমাত্রায় রক্ষণাত্মক মানসিকতার হওয়ায় তাঁর ব্যাটিং দেখাটা হয়ত অনেকের কাছেই একঘেয়ে কিংবা বিরক্তিকর লাগতে পারে। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

দ্রাবিড়কে নিয়ে সাবেক স্পিডস্টার শোয়েব আখতার একটা কথা বলেছিলেন, ‘যদিও, শচীন গ্রেট ব্যাটসম্যান, তারপরও আমার কাছে রাহুলকে বেশি শক্ত আর সলিড ব্যাটসম্যান মনে হয়। ওর ডিফেন্স খুব সলিড, অন্যদের চেয়ে শট কম খেলে। যে শট কম খেরে তাকে আউট করা কঠিন, কারণ শট কম খেলে বলে তার ব্যাটিংয়ে ভুল কম থাকে।’

টেস্ট ইতিহাসের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (১৩২৮৮ রান) এই স্টাইলিশ ডানহাতি ব্যাটসম্যান ক্রিকেট বিশ্বের কাছে ‘দ্য ওয়াল’ নামেই বেশি পরিচিত। টেস্ট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি ৩১,২৫৮টি বল খেলেছেন দ্রাবিড় যেখানে অন্য কেউ ৩০,০০০ বলও খেলতে পারে নি। অদূর ভবিষ্যতে কেউ পারবেন বলে তো মনে হয় না! ‘দ্য ওয়াল’ নামকরণের সার্থকতা বুঝতে এই একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট ! টেস্টে বল খেলার হিসাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছেন যথাক্রমে শচীন টেন্ডুলকার (২৯৪৩৭ বল) এবং জ্যাক ক্যালিস (২৮৯০৩ বল)।

শুধু তাই নয়, মিনিটের হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় ক্রিজে অবস্থান করার রেকর্ডটাও দ্রাবিড়ের দখলে। টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৪১৫২ মিনিট ক্রিজে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ‘লিটল মাস্টার’ শচীন টেন্ডুলকারের ক্রিজে অবস্থানের সময় ৪১৩০৪ মিনিট।

শেন ওয়ার্ন একবার রাহুলের ‘দ্য ওয়াল’ নামকরণ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘রাহুলের জন্য দ্য ওয়াল নামটা  একদম মোক্ষম। ওকে চাইলে দুর্গও বলা যায়। কারণ, ও যখন উইকেটে সেট হয়ে যায় তখন ওকে আউট করার জন্য আসলে বোলিং নয় এক ডজন আগুনের গোলা দরকার।’

নিখুঁত টেকনিক, দুর্দান্ত টেম্পারমেন্টের পাশাপাশি দ্রাবিড়ের বড় শক্তিমত্তার জায়গা ছিল কন্সিসটেন্সি। এ কারণে প্রায়ই তাঁকে ‘মি. কন্সিস্ট্যান্ট’ নামে ডাকা হত। যেকোন ধরনের উইকেট ও কন্ডিশনের সাথে চমৎকার মানিয়ে নিতে পারতেন বলে আলাদা একটা সুখ্যাতি ছিল দ্রাবিড়ের। কন্ডিশন অনুযায়ী ব্যাটিংয়ে প্রয়োজন মত টেকনিক্যাল অ্যাডজাস্টমেন্ট আনার এই গুণকে বলা হয় অ্যাডাপ্টিবিলিটি। অনেকের মতে, এক্ষেত্রে তিনি লারা কিংবা শচীনের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন।

আমার ধারণা, দ্রাবিড়ের মত সোজা ব্যাটে খুব কম ব্যাটসম্যানই খেলেছেন। বলের লেংথ ও বাউন্স বুঝে সময় মত ফ্রন্টফুটে বা ব্যাকফুটে গিয়ে খেলার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অবিশ্বাস্য দক্ষতা। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলের উপর থেকে চোখ সরাতেন না তিনি। বাউন্সি উইকেটে পেসারদের লাফিয়ে ওঠা বলগুলো ব্যাকফুটে গিয়ে অসামান্য দক্ষতায় মাটিতে নামিয়ে এনে ডিফেন্স করতেন তিনি।

কিংবদন্তী ফাস্ট বোলার গ্লেন ম্যাকগ্রার মতে, ‘দ্রাবিড় ক্লাস ব্যাটসম্যান। নিজের যোগ্যতা ও অন্যদের চেয়ে ভালই বোঝেন। ও ওমন নয়, যে প্রতি বলেই রান চায়। আর অন্যদের মত ওর খেলায় খুব একটা দুর্বলতা নেই।’

ব্যাকফুটে গিয়ে গালি ও পয়েন্টের ঠিক মাঝখান দিয়ে নিখুঁত প্লেসমেন্ট করতে পারতেন বলে একটা সময় দ্রাবিড়কে বলা হত ‘মাস্টার অব স্কয়ার কাট’। পেসারদের বলে ভি-অঞ্চল দিয়ে খেলা তাঁর কপিবুক স্ট্রেট কিংবা অন ড্রাইভ, নিখুঁত টাইমিংয়ে চোখ-ধাঁধানো কাভার ড্রাইভ কিংবা অনায়াসে কব্জির মোচড়ে খেলা দৃষ্টিনন্দন ফ্লিক ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। ফাস্ট বোলারদের দ্রুতগতির বাউন্সারের জবাব দিতেন কন্ট্রোলড হুক শটে।

স্পিনারদের বিপক্ষে দ্রাবিড়কে মানা হয় সর্বকালের সেরাদের একজন। টার্নিং উইকেটে তারঁ সফট হ্যান্ডে খেলা স্ট্রোকগুলো ছিল রীতিমত মাস্টারক্লাস। স্পিনের এগেইনস্টে তাঁর সাবলীল ফুট মুভমেন্ট, বলের পিচে গিয়ে খেলা, ‘ডেপথ অফ দ্য ক্রিজ’ ইউজ করা অথবা কব্জির নিখুঁত কারুকাজ! কী ছিল না দ্রাবিড়ের ব্যাটিংয়ে।

দ্রাবিড় সম্পর্কে ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং তারকা ক্রিস গেইল একবার বলেছিলেন, ‘দ্রাবিড় যদি আমার মত আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতো তখনও চাইলে আমি ওর মত হতে পারতাম না।’ আরেকটি সুন্দর মন্তব্য করেছেন ম্যাথু হেইডেন, ‘চার পাশে যা দেখা যায় তার সবই আক্রমণ নয়। ক্রিকেট মাঠে আক্রমণ কি বুঝতে চাইলে দ্রাবিড়ের চোখটা দেখবেন শুধু।’

১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারি মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে এক সম্ভ্রান্ত মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাহুল শারদ দ্রাবিড়। জন্ম ইন্দোরে হলেও একটি জ্যাম ফ্যাক্টরিতে কর্মরত বাবার চাকরিসূত্রে তাঁর বেড়ে ওঠা বেঙ্গালুরুর কর্ণাটকে। সেখানেই পড়ালেখায় হাতেখড়ি, ক্রিকেটেও।

বয়সভিত্তিক দলগুলোতে রানের বন্যা বইয়ে দিয়ে ১৯৯১ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। কর্ণাটকের হয়ে মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রঞ্জি অভিষেকেই তিনি খেলেন ৮২ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। একদিনের ক্রিকেটে রাহুলের অভিষেক ১৯৯৬ সালের ৩ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। অবশ্য খুব একটা মনে রাখার মত ম্যাচ ছিল না সেটা। মুরালিধরনের ঘূর্ণিতে আউট হবার পূর্বে দ্রাবিড় করতে পেরেছিলেন মোটে ৩ রান। তবে ফিল্ডিংয়ে নেমে দারুণ দুটি ক্যাচ নিয়েছিলেন তিনি।

১৯৯৬ সালের ২০ জুন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে তাঁর স্মরণীয় টেস্ট অভিষেক। একই ম্যাচে অভিষিক্ত হয়েছিলেন বাংলার ক্রিকেটের ‘মহানায়ক’ সৌরভ গাঙ্গুলি। অভিষেক ইনিংসে দ্রাবিড় নেমেছিলেন ৭ নম্বরে। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৫ রান দূরে থাকতে ইংলিশ পেসার ক্রিস লুইসের বলে কট বিহাইন্ড হন তিনি। ডেব্যু টেস্টেই জাত চেনানো ৯৫ রানের সেই ইনিংস খেলতে প্রায় ৬ ঘন্টারও বেশি সময় দাঁতে দাঁত চেপে ক্রিজে পড়ে ছিলেন তিনি।

১৯৯৭ সালে জোহানেসবার্গের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে স্বাগতিকদের বিপক্ষে হাঁকান ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর প্রথম শতরানটি আসে চেন্নাইতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ১৯৯৭ সালে। ওই ম্যাচেই পাকিস্তানি ওপেনার সাঈদ আনোয়ার তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ১৯৪ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন যেটি ওয়ানডে ইতিহাসের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড হিসেবে টিকে ছিল বহু বছর।

১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নিজের প্রথম বিশ্বকাপেই ৪৬১ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। ওই বিশ্বকাপেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সৌরভ গাঙ্গুলির (১৫৮ বলে ১৮৩) সাথে মিলে ৩১৮ রানের বিশাল এক পার্টনারশিপ গড়েছিলেন দ্রাবিড় (১২৯ বলে ১৪৫)। তখন ওটাই ছিল একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ জুটির তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড।

১৯৯৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে জুটি বেঁধে ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩৩১ রানের রেকর্ড জুটি গড়েছিলেন দ্রাবিড়(১৫৩)। পরে অবশ্য ২০১৫ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল ও মারলন স্যামুয়েলস মিলে ৩৭২ রানের জুটি গড়ে ভেঙে দেন সেই রেকর্ড। টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটি করেছিলেন ২০০০ সালে, দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

২০০১ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লক্ষণ-দ্রাবিড়ের ৩৭৬ রানের জুটিকে বলা হয় টেস্ট ইতিহাসের এক অমর উপাখ্যান! লক্ষণের ২৮১ রানের ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ ইনিংসের আড়ালে চলে যাওয়া দ্রাবিড়ের ১৮০ রানের ‘মূল্যবান’ ইনিংসটির গুরুত্ব কোন অংশে কম ছিল না। ফলো অনে পড়েও স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়াকে ভারত সেবার হারাতে পেরেছিল ‘কালজয়ী’ এই জুটির কল্যাণেই!

২০০২ সালে হেডিংলি টেস্টে ১৪৮ রান করে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। ১৬ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে সেবারই প্রথম টেস্ট জিতেছিল ভারত। ২০০২ সালে সেন্ট জনস টেস্টে স্লো মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে রিডলি জ্যাকবসকে আউট করেছিলেন দ্রাবিড় যা তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের একমাত্র উইকেট।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দীর্ঘ ২৩ বছর পর প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় ভারত; সেটাও এই দ্রাবিড়ের হাত ধরেই। ২০০৩ সালে অ্যাডিলেড টেস্টের দুই ইনিংসে ২৩৩ এবং ৭২ রানের অনবদ্য দুটো ইনিংস খেলে দলকে অবিস্মরণীয় এক জয় এনে দেন তিনি।

হাতে ভাল বিকল্প না থাকায় ২০০২-২০০৪ এই সময়টাতে নিয়মিত উইকেটরক্ষকের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে দ্রাবিড়কে। ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতকে ফাইনালে তুলতে গ্লাভস হাতে রাহুলের অবদানটা ভুলে গেলে চলবে না। উইকেটরক্ষক হিসেবে তাঁর দলে অন্তর্ভুক্তির কারণেই একাদশে একজন বাড়তি খেলোয়াড় খেলানোর সুবিধা পেত ভারত।

২০০৪ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ২৭০ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলেন দ্রাবিড়। এই ইনিংসে ভর করেই প্রথম বারের মত পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জেতে ভারত। সেটা ছিল আবার ১২ বছর পর বিদেশের মাটিতে ভারতের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়।

স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পর দ্রাবিড়ই ইতিহাসের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান যিনি পর পর তিনটি সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ২০০৩-০৪ মৌসুমে টানা তিন সিরিজে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে আহমেদাবাদে ২২২, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাডিলেডে ২৩৩ এবং রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৭০ রান করেছিলেন তিনি।

২০০৪ সালে চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ‘প্রথম’ ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০ টি টেস্ট খেলুড়ে দেশেই সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন দ্রাবিড়। ২০০৪ সালে একই সাথে ‘আইসিসি প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ এবং ‘আইসিসি টেস্ট ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ খেতাবে ভূষিত হন দ্রাবিড়। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা আইসিসির উদ্যোগে ক্রিকেটারদের সম্মান জানানোর এই উদ্যোগটা শুরুটা হয়েছিল রাহুলকে দিয়েই।

২০০৫ সালে প্রথম বারের মত ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনোনীত হন রাহুল দ্রাবিড়। ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালে দ্রাবিড়ের অধিনায়কত্বেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথম বারের মত টেস্ট সিরিজ জেতে ভারত। সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচের দুই ইনিংসে দ্রাবিড় করেছিলেন ৮১ আর ৬৮। ইনিংস দুটো কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা বোঝাতে একটা তথ্য দিই। সে ম্যাচে ফিফটি করা একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যানও যে তিনিই ছিলেন! ২০০৭ সালে রাহুলের অধিনায়কত্বেই ২৬ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জেতে ভারত।

২০১১ সালে জাতীয় দলের হয়ে শেষ বারের মত ইংল্যান্ড সফরে যান দ্রাবিড়। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় সিরিজটা ৪-০ ব্যবধানে ‘হোয়াইটওয়াশ’ হয় ভারত। তবে ইংলিশ কন্ডিশনে সুইং ও সিম মুভমেন্টের সামনে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের অসহায় আত্মসমর্পণের বিপরীতে একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিই! ৩ সেঞ্চুরিতে দ্রাবিড় যেখানে একাই করেছিলেন ৪৬১ রান যেখানে আর কোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যানের ১টা সেঞ্চুরিও ছিল না! রাহুলের তিন সেঞ্চুরির দুটো আবার এসেছিল মেকশিফট ওপেনারের ভূমিকায়!

২০১১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কার্ডিফে ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে ম্যাচটি খেলেন দ্রাবিড়। গ্রায়েম সোয়ানের বলে বোল্ড হবার পূর্বে তিনি খেলেছিলেন ৭৯ বলে ৬৯ রানের ঝকঝকে একটি ইনিংস। টেন্ডুলকারের মত রাহুলও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন মাত্র একটি। ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ওই একই সফরে। সে ম্যাচে রাহুল করেছিলেন ৩১ রান।

টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক শতরানের জুটির অংশীদার হলেন রাহুল দ্রাবিড়। তাঁর ক্যারিয়ারে মোট ৮৮টি সেঞ্চুরি জুটির অংশ হয়েছেন তিনি! আর টেস্ট ক্রিকেটে ‘জুটি’ হিসেবে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক শচীন টেন্ডুলকার-রাহুল দ্রাবিড় জুটি (২০ টি)। শচীন টেন্ডুলকারের পর ভারতের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটের ক্রিকেটেই ১০ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন রাহুল দ্রাবিড়।

ওয়ানডে ইতিহাসে দ্রাবিড়ই একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি দুটি তিন শতাধিক রানের জুটির (৩৩১ ও ৩১৮) অংশীদার হয়েছিলেন। টেস্টে মোট ১১ বার ম্যাচ সেরা’ হবার গৌরব অর্জন করেন দ্রাবিড়। যার মধ্যে আটটিই ছিল দেশের বাইরে!

ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি দুর্দান্ত ফিল্ডার হিসেবেও তিনি আলাদা সুনাম অর্জন করেছেন। টেস্ট ইতিহাসের রেকর্ড সর্বোচ্চ ২১০টি ক্যাচ নিয়েছেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ফিল্ডার যার বেশিরভাগই এসেছে স্লিপে।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাডিলেড টেস্টটাই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেই টেস্টের দুই ইনিংসে যথাক্রমে ১ ও ২৫ রান করেন রাহুল। ওই বছরই মার্চ মাসের ৯ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান দ্রাবিড়।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পরও ক্রিকেটের সাথেই তাঁর সম্পৃক্ততা। বেশ কয়েক মৌসুম তিনি খেলেছেন আইপিএলে। ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। ইদানীং ধারাভাষ্যকক্ষেও প্রায়শই দেখা যায় তাঁকে। ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হেড কোচের দায়িত্বও সফলভাবে পালন করছেন তিনি। এই তো বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে তাঁর কোচিংয়েই রানার্সআপ হবার গৌরব অর্জন করে ভারতীয় অনুর্ধ্ব-১৯ যুব ক্রিকেট দল।

১৬ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে ১৬৪টি টেস্ট খেলেছেন রাহুল। ২৮৬ ইনিংসে ৫২.৩১ গড়ে করেছেন ১৩ হাজার ২৮৮ রান। আছে ৩৬ টি সেঞ্চুরি এবং ৬৩ টি হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ ইনিংস ২৭০ রানের। বল হাতে ১টি উইকেট আর ফিল্ডার হিসেবে ক্যাচ নিয়েছেন ২১০টি।

১৫ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩৪৪ ম্যাচে দ্রাবিড়ের রান ৩৯.১৬ গড়ে ১০ হাজার ৮৮৯। আছে ১২টি শতক আর ৮৩টি অর্ধশতক। সর্বোচ্চ ইনিংস ১৫৩ রানের। বল হাতে ৪২.৫০ গড়ে ৪টি উইকেটও আছে তাঁর। উইকেটরক্ষক হিসেবে ১৪ টি স্টাম্পিংসহ মোট ক্যাচ নিয়েছেন ১৯৬টি।

খেলোয়াড়ি জীবনে রাহুল দ্রাবিড় ছিলেন বরাবরের পার্শ্বনায়ক। সব সময় নিজের চাইতে দলের কথা বেশি ভেবেছেন বলে অন্যান্য লিজেন্ডদের তুলনায় পরিসংখ্যানে তিনি হয়ত কিছুটা পিছিয়ে থাকবেন। অথচ তাঁর ক্রিকেটীয় অর্জনের পাল্লাটা নেহায়েত কম ভারী নয়। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তাঁকে থাকতে হয়েছে টেন্ডুলকারের ‘ছায়াসঙ্গী’ হয়ে। যে কারণে তিনি কখনোই ঠিক সেভাবে লাইম লাইটের নিচে আসতে পারেন নি। এমনকি ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংস (১৫৩ রান) খেলার দিনেও তারকাদ্যুতিতে তাঁকে ম্লান করে দিয়েছিলেন ভারতীয় লিটল মাস্টার!

এই বিষয়টা নিয়ে মুরালিধরন একটা কথা বলেছিলেন, ‘রাহুল বরাবরই শচীনের ছায়া হয়ে থেকেছেন। তবে, কখনোই আমি দু’জনের তুলনা করতে পারবেন না। কারণ, দু’জনের ব্যাটিংয়ের ধরণ ভিন্ন। তবে, দ্রাবিড় পরিপূর্ণ এক ক্রিকেটার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link