ওই ছোট্ট এক চিলতে একটা ট্রফি। আসলে ট্রফিও না। একটা ছোট্ট কাঠের বাক্সে কিছুটা ছাই। কিন্তু তাই নিয়েই কি ফাটাফাটি ! আজকের টি-টোয়েন্টি, শপিং মল, ৪-জি অধ্যুষিত জমানাতেও মাস খানেক চুটিয়ে টেস্ট ম্যাচের টিকিট বিকোয় যখন ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া একে অপরের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। অ্যাশেজ সিরিজ আসা মানেই গোটা বিশ্বের ক্রিকেট পাগলরা মাছির মতো টিভির সামনে ভনভন করবে। ভারতীয় বা বাংলাদেশিরা তো বটেই।
অ্যাশেজ দেখছি সেই ২০০৫ থেকে। এখনও সিরিজ শুরুর আগে একটা অদ্ভুত শিহরণ যেন টের পাই। এবারের সিরিজ শুরুর আগে তাই কিছুটা স্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগ ছাড়তে পারছি না। আজ লিখছি অ্যাশেজে আমার দেখা সেরা ব্যাটিং নিয়ে।
ইনিংস না লিখে ব্যাটিং শব্দ টা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করেছি। কারণ তুল্যমূল্য বিচারে যে দুইখান ইনিংসের কথা বলবো, তার একটা আরেকটার থেকে কেন ভালো বা খারাপ সেই যুক্তি অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাইনি। অ্যাশেজে বহু ইনিংস দেখেছি। বহু রকমের ইনিংস।
যেমন ২০০৫ এ মাইকেল ভনের অস্ট্রেলিয়াকে লন্ডভন্ড করে দেওয়া ওল্ড ট্র্যাফোর্ড সেঞ্চুরি, ২০০৫ এই এবং ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই রিকি পন্টিংয়ের ম্যাচ বাঁচানো সেঞ্চুরি, কেভির পিটারসেনের শেন ওয়ার্নকে পিটিয়ে ওভালের ১৫৮, ২০০৬-০৭ এ গিলক্রিস্টের পার্থের মরুঝড় সম সেঞ্চুরি, ২০০৬-০৭ এ অ্যাডিলেডে মাইক হাসির ড্র হতে যাওয়া ম্যাচ জেতানো এবং ইংল্যান্ডকে সিরিজ থেকে ছিটকে দেওয়া ইনিংস, ২০০৯ এ কলিংউডের ১ব্রিগেডিয়ার ব্লক’, ২০১০-১১ সিরিজে অ্যালিস্টেয়ার কুকের ৭৬৬ রান অস্ট্রেলিয়ার গরম আবহাওয়ার কড়াইতে রান্না করা, বেন স্টোকসের হেডিংলি ইনিংস, স্মিথের ২০১৭ ব্রিসবেনে শ্রমিক সেঞ্চুরি ও আরও অনেক। কিন্তু আজকে যেই দুটি ইনিংসের কথা লিখবো, ইমপ্যাক্ট বা কনটেক্সটে বাকিগুলোর থেকে একেবারে আলাদা। তাই আর গৌরচন্দ্রিকা না করে শুরু করে দেওয়াই ভালো।
আমার লেখার প্রথম নায়ক একটি অন্য দেশ থেকে এসে সবে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছেন। আর দ্বিতীয় নায়ক দু বছরের কালিমালিপ্ত নির্বাসন কাটিয়ে আবার অস্ট্রেলিয়া দলে ফিরেছেন। তবে তাঁর থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে সেনাপতির মুকুট। প্রথম জন টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে ওয়ানডের মঞ্চ জ্বালিয়ে দিয়েছেন ২১ ম্যাচে ৮৭ গড় ও ৯৯ স্ট্রাইক রেট নিয়ে। দ্বিতীয় জন অ্যাশেজ সিরিজ শুরুর অব্যবহিত আগে সমাপ্ত হওয়া বিশ্বকাপ শেষ করেছেন নিতান্ত মধ্যবিত্ত ৩৭.৯০ গড় নিয়ে।
প্রথম জন এসেছেন ক্রিকেটের রক্ষণশীলতার মঞ্চে তাঁর আধা সোনালী আধা কালো চুলের ভয়ডরহীন ক্রিকেট অস্তিত্ব জানান দিতে। দ্বিতীয় জন এসেছেন তাঁর টলমান ক্রিকেট অস্তিত্ব রক্ষা করতে। প্রথম জনের মঞ্চ ইংল্যান্ডের সবচেয়ে অভিজাত মাঠ লর্ডস। দ্বিতীয় জনের মঞ্চ ইংল্যান্ডের সবচেয়ে কোলাহলমুখর মাঠ এজবাস্টন। প্রথম জন কেভিন পিটারসেন। দ্বিতীয় জন স্টিভ স্মিথ।
আগে পিটারসেনের ইনিংসটা নিয়ে বলি। অস্ট্রেলিয়া ১৯০ রানে গুটিয়ে যাবার পর, ইংল্যান্ড সমর্থকরা তখন অস্ট্রেলিয়াকে ৭১ বছর পর লর্ডসে হারানোর স্বপ্ন দেখছেন। সেই স্বপ্নালু চোখে আচমকা ধুলো দেওয়া শুরু করে দিলেন ম্যাকগ্রা। পিটারসেন যখন নামলেন, স্কোর ১৮ রানে ৩ উইকেট। কিছুক্ষনের মধ্যেই ২১ রানে ৫ উইকেট। ম্যাকগ্রার সামনে তখন ইংল্যান্ডকে সেই ইংরেজি প্রবাদের বেড়ালটার মতো মনে হচ্ছে।
আরে সেই বেড়ালটা, যে একটা গরম টিনের চালে ভুল করে উঠে গিয়ে নামতে না পেরে লাফালাফি করছে। পিটারসেন এই সময় আউট হয়ে গেলে কারুর কিছুই বলার থাকতো না। ভন, ট্রেসকোথিক, আগের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর কাঁপানো স্ট্রাউসের মতো হাতি ঘোড়ারাই তলিয়ে গেলো। সেখানে মশা তলিয়ে গেলে কার কি বলার থাকে? কিন্তু পিটারসেন সেই জেদি মশা। যে বলে, ‘আরে ধুর ! হাতি ঘোড়া ডুবেছে তো কি হয়েছে? এ আর এমন কি জল?’
তবে তাই বলে ভেবে বসবেন না যে পিটারসেন প্রথম বল থেকেই একেবারে মারমার কাটকাট। প্রথম রান পেলেন নবম বলে। ব্রেট লি কে অফে ঠেলে। তার আগে ম্যাকগ্রার বল গুলো হয় ছেড়ে দিয়েছেন, নয়তো দেখে শুনে ডিফেন্স। ২১ রানে ৫ হবার পর বরং জোন্স কয়েকটা সাহসী বাউন্ডারি মেরে ইনিংস এগিয়ে নিয়ে যান। প্রথম ৫০ বলে পিটারসেন মাত্র ১৯। যে কটা চার মেরেছেন বেশির ভাগই গিলেস্পির বলে। যিনি কয়েকটা উপহার প্রদান করেছেন পিটারসেনকে। স্কোর যখন ১০১ রানে ৮ উইকেট, পিটারসেন নিজে ৮১ বলে ৩৬, বোলিং মার্কে ম্যাকগ্রা।
পিটারসেন শুরু করলেন তাঁর ধ্বংসলীলা। ম্যাকগ্রার প্রথম ৩ বলে ১৪ রান নিলেন। এবং এমন ভঙ্গিতে নিলেন যেন তিনি কেপ টাউনের ক্লাব বোলার। পরের ওভারে ওয়ার্নকে স্পিনের বিরুদ্ধে একটা ৬ মারলেন। পরের বলটা আবার তুলে মারতে গিয়েই ক্যাচ আউট। রান মাত্র ৫৭। ধংসলীলাটাও ক্ষণস্থায়ী। যেমন হালকা ভূমিকম্প দিল্লী বা কলকাতায় মাঝে মাঝেই হয়। কিন্তু সেদিনের ক্রিকেট রিখটার স্কেল যা মাপতে পারেনি তা হলো পিটারসেনের প্রভাব।
শয্যাশায়ী ইংল্যান্ডকে মোটামুটি একার হাতে উদ্ধার করলেন। ইংল্যান্ড সেই ম্যাচ হেরে যায়। কিন্তু পিটারসেন অজি ক্রিকেটের কেল্লায় সেদিন যে ছোট্ট ফাটলটা ধরিয়েছিলেন, মাস দেড়েক পর সেই ফাটল গহ্বর-সম হয়ে দাঁড়ায়। সেই গহ্বর গলেই মাইকেল ভন ‘ছাইদানি’ জিতে নেন। এবং পিটারসেন ইংরেজ ক্রিকেটের লোকগাথায় তাঁর অমরত্বের ফিক্সড ডিপোজিটে প্রথম বিনিয়োগটি করেন।
এর ১৪ বছর পর আবার একটা অ্যাশেজ। এবার ইংল্যান্ড সদ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। অস্ট্রেলিয়া ঘরের মাঠে ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ হেরে, গত ১৮ বছরে ইংল্যান্ড থেকে একবারও অ্যাশেজ উদ্ধার করে নিয়ে যেতে না পেরে, বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ছিটকে গিয়ে একেবারেই হিসাবের বাইরে। স্কোর ১৭ রানে ২, এই অবস্থায় নামলেন স্টিভ স্মিথ। অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে কয়েকটা বল ছাড়াছাড়ি আর ডিফেন্স করতে না করতেই, স্কোর ৩৫ রানে ৩ উইকেট। কিছু পরে ১২২ রানে ৮ উইকেট। স্মিথ তখন ৪২। এরপর চালিয়ে খেলা ছাড়া উপায় কি? স্মিথ করলেনও তাই।
পিটার সিডল যোগ্য সঙ্গত করছিলেন। কিন্তু সে আর কতক্ষন? ২১০ রানে ৯ উইকেট। স্মিথ ৮৫। কামব্যাক সেঞ্চুরিটা হবে কি? আসলে ওখানে প্রশ্ন বোধক চিহ্নটার দরকারই ছিল না। ঠিক তার আগের মরসুমেই একই মাঠে স্মিথের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দিল্লির এক যুবক একই অবস্থা থেকে দলকে একা টেনে নিয়ে যান। নিজে শেষ করেন ১৪৯ এ। স্মিথকে তো করতেই হতো। দিল্লির ডি.এল.এফ পার্কে সেরা ব্যাটারের অদৃশ্য তাজটাকে একটু চ্যালেঞ্জ না করলে তিনি কিসের স্টিভ স্মিথ? স্মিথ শেষ করলেন ১৪৪ এ। অস্ট্রেলিয়া ২৮৪।
স্মিথের ব্যাটিংয়ে ইংল্যান্ড যে বিহ্বলতার স্টেশনে প্রবেশ করলো, গোটা ম্যাচে আর সেখান থেকে ইংল্যান্ডের ট্রেন ছাড়তে পারেনি। স্মিথ দ্বিতীয় ইনিংসেও সেঞ্চুরি। টিম পেইনের মধ্যবিত্ত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ ২-২ করে ফিরলো। স্মিথ একার কাঁধে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং বইলেন। নির্বাসন শেষে রাজার মতো ফিরলেন। যদি কোনো কর্পোরেট সেমিনারের বক্তা অনন্ত চাপ আর হতাশার মধ্যেও কিভাবে টপ লেভেল পারফর্মার নিজের কাজটি করে যান, এই বিষয়ে ভিডিও দেখাতে চান, স্টিভ স্মিথের এই ইনিংসের কিছু ঝলক তার কাজ ক্রিকেট পাগল ভারতবর্ষে আরামসে করে দেবে।