সাল ২০২০, চার টেস্টে ২০.৩৮ গড়ে আপনার মোট রান একশো তেষট্টি। সাল ২০২১, চোদ্দো টেস্টে আপনার রান সাতশো দুই, গড় ২৮.০৮। আর এই বছরে দু টেস্টে আপনার রান একশো আট, গড় সাতাশ। গত কিছুদিনে ভারতীয় ক্রিকেটের হট টপিক থেকেছে যে আপনি কি জীবনের শেষ টেস্ট নেলসন ম্যান্ডেলার দেশেই খেলে ফেললেন? আপনি ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টির গ্রহে ‘এলিয়েন’, অতএব টেস্ট জীবন শেষ হয়ে যাওয়া মানে আপনার পুরো ক্রিকেট জীবনই মোটামুটি শেষ!
এবং আপনার ক্রিকেট জীবন নিয়ে এই আশঙ্কা, এই দোলাচল জীবনের খুব বড় একটা সত্যিকে জোর গলায় ঘোষণা করছে; মানুষের জীবন যেমন অনিত্য ঠিক তেমনি তার সাফল্য নিয়ে যে উচ্ছাস তার আয়ু ও বড়ই ক্ষুদ্র। এই বছর খানেক আগের গাব্বার সেই অলৌকিক জয়ে চেতেশ্বর অরবিন্দ পুজারা নামের এক ক্রিকেটারের ছাপ্পান্ন রানের ইনিংস নিয়ে উত্তাল ছিল সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী।
আর আজ ‘পূজারা হটাও টিম বাঁচাও’ এরকম একটা আন্দোলন প্রায় শুরু হবার মুখে । তিন বছরের স্ট্যাট অবশ্য খুব জোরালো ভাবেই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আপনার ক্যারিয়ার ক্রমশ: শেষ বিকেল পেরিয়ে গোধূলির দিকে এগোচ্ছে । টেস্টে তিন নম্বর জায়গায় নামেন যে ব্যাটসম্যান তাঁর গড় যদি তিন বছর ধরে চল্লিশ এর অনেক নীচে ঘোরাফেরা করে তবে সেটা মোটেও খুব আশাব্যঞ্জক নয়।
পূজারা আপনার ব্যাটিংয়ে কোনোদিন লক্ষ্মণ বা আজহারের শৈল্পিক ব্যাপার ছিল না, বীরেন্দ্র শেবাগের ফ্ল্যামবয়েন্সও কোনোদিন ছিল না, কোহলি বা শচীনের মহাপ্রতিভা ঈশ্বর আপনাকে দেন নি। আপনি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে ‘ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের’ মত বিশ্বস্ত এক প্রতিষ্ঠান। যার ঝলক নেই, রংবাহারি কোনো ব্যাপার নেই, ঝলমলে উজ্জ্বলতা নেই। তাহলে কী আছে ? আছে নীরব এক উচ্চারণ।
এক নীরব কর্মী খুঁটে, খুঁটে ইনিংস টাকে গড়ে তুলবেন আর সেই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে কোহলি বা রোহিত বা পন্থ স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছোটাবেন । দিনের শেষে আপনি সেইভাবে প্রচারের আলোতেও আসবেন না। অন্যরা যখন প্রচারের আলোয় নিজেদেরকে সেঁকবেন, সৌরাষ্ট্রের ‘চিন্টু’ তখন নি:শব্দে পরের লড়াইটার জন্য তৈরী হবেন।
একটা ক্রিকেট ঘরানা থেকেই আপনি এসেছিলেন। বাবা অরবিন্দ এবং কাকা বিপিন সৌরাষ্ট্রের হয়ে রঞ্জি খেলেছিলেন । খুব ছোটবেলাতেই বাবা অরবিন্দ এবং মা রিমা ঠিক করে ফেলেন যে তাঁদের চিন্টু ক্রিকেটার হবে এবং শুধুই ক্রিকেটার। ২০০৫ এ মা রিমা চলে গেলেন যখন তখন আপনি মাত্র সতেরো। তারপর শুরু হল বাবা – ছেলের লড়াই । ক্রিকেটার হবার লড়াই। বাবার পরেই আপনি একজনের কথা খুব বলেন , তিনি দেবু মিত্র। এই বাঙালি সৌরাষ্ট্র রঞ্জি দলে আপনার কোচ ছিলেন এক সময়ে।
টেস্টে আঠারো সেঞ্চুরি এবং বত্রিশ হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট এ এই ধরনের স্ট্যাট নিজের নামের পাশে দেখতে চাইলে অনেক রক্ত আর ঘাম ঝরাতে হয় , ক্রিকেট খুব বেশি না বুঝলেও এটুকু তো বুঝি । আর বুঝি বলেই মনেপ্রাণে চাইছি ক্রিকেট ঈশ্বর আপনাকে অন্তত: পাঁচটা টেস্ট খেলার সুযোগ দিন। হ্যাঁ, তার বেশি যদি নাও হয় অন্ততঃ পাঁচটা টেস্ট। ওই পাঁচটা টেস্ট খেললে আপনার একশো টেস্টের ‘মাইলস্টোন’ ছোঁয়া হবে । ভারতীয় ক্রিকেটের নীরব সেবক হিসেবে চেতেশ্বর পুজারার এটুকু অন্তত: পাওয়াই উচিত।
ব্যক্তিগত ভাবেও খুব চাই আপনি অন্তত: আর কিছুদিন খেলুন। আসলে আমরা যারা নেহায়েৎই মধ্য বা নিম্ন মেধার , তাঁদের সামনে আপনি উপযুক্ত রোল মডেল যে। টুকটাক লিখি ফেসবুকে, কখনো কখনো কোথাও লেখা পাঠিয়েছি একটা আধটা। যদিও একটা ও লেখা কোথাও ছাপা হয়নি। হবেও না হয়তো কোনো দিন। কিন্তু কোথাও লেখা ছাপা না হবার হতাশা টুকু ঝেড়ে ফেলে আবার কাগজ কলম নিয়ে বসার জন্য একজন চেতেশ্বর অরবিন্দ পুজারার সামনে থাকাটা যে খুব জরুরি।
ওই যে লোকটা কামিন্স এর বাউন্সার হেলমেটের গ্রিলে খাচ্ছে, রাবাডার বিষাক্ত ছোবলটা পাঁজরে নিচ্ছে। কখনো পড়ে যাচ্ছে মাটিতে, আবার ও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা রক্তবিন্দু গ্লাভস এর উল্টো পিঠে মুছে আবার দাঁড়াচ্ছে। আবার লড়বে লোকটা। ভগবান লোকটাকে অঢেল প্রতিভা হয়তো দেননি কিন্তু ওই পড়ে গিয়ে ও উঠে দাঁড়ানোর স্থিরতা আর শক্তি দিয়েছেন। ওইটা সম্বল করেই মাঠের মধ্যে লড়ছে লোকটা। আর তাকে সামনে রেখে মাঠের বাইরে আমরা।