আজ ষোলোটি বছর পর…

২০০৬ সালের ঘটনা। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ইনডোরে ঐচ্ছিক অনুশীলনে এসেছি বড় ভাইটি। পরিচিত সাংবাদিকদের দেখে একটু গল্প করছেন। কথা কথায় হাসতে হাসতে বললেন, ছোট ভাইটাও দ্রুত জাতীয় দলে ঢুকে পড়বে। নিজেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, ‘ওই যে, ভাই বোলিং মেশিনের সামনে ব্যাট করছে।’

বড় ভাইয়ের মুখে তখন গর্বের হাসি।

হাসিটা মুখেই ঝুলে রইলো। হঠাৎ একটা বল ভয়ঙ্কর গতিতে ছুটে এলো বড় ভাইয়ের দিকে। ঠিক চোখের ওপরে লাগলো বলটা। শট করা ব্যাটসম্যানটি সেই আপন ছোট ভাই। শিউরে উঠে ছুটে এল ‘পিচ্চি’ ছোট ভাইটা।

এখান থেকেই শুরু হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ট্রাজিক ও রোমান্টিক এক গল্প। ওই ঘটনার পর আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি সেই বড় ভাইয়ের। আর এই ঘন্টার এক বছরের মাথায় জাতীয় দলে বড় ভাইয়ের জায়গাটা নিলো সেই ছোট ভাইটা।

বুঝতেই পারছেন এই দুই ভাই কে! হ্যা, নাফিস ইকবাল আর তামিম ইকবাল।

এরপর পদ্মায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। বিশ্বের মানচিত্রে অনেক ওলোট পালোট হয়েছে। আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করেছেন নাফীস ইকবাল। দুই ভাই একসাথে অনেক প্রথম শ্রেনীর, ঘরোয়া একদিনের ম্যাচে ইনিংস শুরু করেছেন। দুই ভাই-ই বিভিন্ন আড্ডায় বলেছেন, স্বপ্নের কথা-একসাথে জাতীয় দলে খেলতে চান। কিন্তু সেই স্বপ্নটা সত্যি হয়নি।

অত:পর ইতিহাস একটু মজা করলো আজ।

সেই নাফিস ও তামিম আজ তাদের জন্মভূমি চট্টগ্রাম শহরেই পাশাপাশি হেটে এসে সাংবাদিকদের সামনে দাড়ালেন। তামিম বসে বসে কথা বললেন। পাশে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলেন নাফীস। আজ তাদের পরিচয়টা একটু বদলে গেছে-তামিম ইকবাল অধিনায়ক এবং নাফিস ইকবাল ম্যানেজার। ইতিহাস এক সুতোয় গেঁথে ফেলেছে তাদের।

তামিম ইকবালের ব্যাপারে আর বলার কিছু নেই। অবিসংবাদিতভাবে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাট বা সময় দিয়ে এই সফল ব্যাটসম্যানকে বিচার করা যাবে না। সব রেকর্ড বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তার চেয়ে সফল কোনো ব্যাটসম্যান আসেননি।

২০০৭ বিশ্বকাপে প্রায় অচেনা এক তরুন হয়ে গিয়েছিলেন। জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেট ছক্কা মেরে নিজেকে চিনিয়েছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমার্থক হয়ে উঠেছেন। এখন ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব করছেন।

নাফীস ইকবাল সম্ভাবনার দিক থেকে আরও বেশি ছিলেন। বয়স ভিত্তিক সময় থেকে তাকে ‘ভবিষ্যত অধিনায়ক’ বলে বিবেচনা করা হতো। যেসব স্তরে খেলেছেন, অধিকাংশ সময় নেতৃত্ব ছিলো তার হাতে। সেই সাথে ছিলো ব্যাটসম্যানশিপ।

অ্যাশলে জাইলসকে ‘অর্ডিনারি স্পিনার’ বলে তার ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়া এক সেঞ্চুরি করে আর্ন্তজাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলেন। এরপর জাতীয় দলে এলেন। তার সেঞ্চুরিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতেছিলো বাংলাদেশ।

এরপর ইনজুরি, ফর্মহীনতা মিলিয়ে আর জাতীয় দলে টেকা হয়নি। মাঝে বেশ কয়েকটা মৌসুম ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুন পারফরম করলেও জাতীয় দলের দরজা আর খোলা হয়নি।

দ্রুতই, খুব দ্রুত অবসর নিয়ে নিয়েছেন ক্রিকেট থেকে। অবসরের পর থেকে কাজ করছেন পেশাদার ম্যানেজার হিসেবে। বিপিলের দল সামলেছেন, জাতীয় ‘এ’ দল সামলেছেন। পেশাদারিত্ব বুঝতে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অন্দর মহল দেখে এসেছেন। অবশেষে বিসিবি তাকে দিয়েছে জাতীয় দলের দায়িত্ব।

নিয়তি অনেক কিছু কেড়ে নেয়। আবার অন্য কোনো রূপে ফিরিয়ে দেয়। দুই ভাইয়ের একসাথে জাতীয় দলে খেলা না হলেও একসাথে জাতীয় দলের কাঠামোতে তো এলেন।

তবে, এই জায়গায় তাঁরা পুরোপুরিই পেশাদার। সংবাদ সম্মেলনে তামিম বললেন, ‘দেখুন, এটা একটা এমন জায়গা, আমাদেরকে খুব খুব বেশি পেশাদার হতে হবে। হ্যাঁ, তিনি আমার ভাই। আমাদের সম্পর্ক আছে। তবে জাতীয় দলে দায়িত্ব পালন করার সময় ম্যানেজার হিসেবে তাকে আমার সম্মান করতে হবে, তারও আমাকে সম্মান করতে হবে খেলোয়াড় হিসেবে। এটা পেশাদার জায়গা যেখানে সম্পর্ক আসে পরে, পেশাদারিত্ব প্রথমে।’

যাই হোক, তাও নিয়তি দু জনকে মিলিয়ে দিলো বাড়ির আঙিনাতে এনেই। সেই চট্টগ্রামেই আবার জুটি বাঁধলেন তাঁরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link