বয়স মোটে ২১। অভিজ্ঞতা তেমন কিছু নেই। তবে আছে বিশাল হৃদয়। ক্রিকেট ব্যাটের প্রস্থ সর্বোচ্চ ৪.২৫ ইঞ্চি। কিন্তু এই ছেলেটির ব্যাট তার কলিজার সমান চওড়া।
তার যে বয়স, নিজেকে জাহির করার প্রবণতা এই বয়সে প্রায় সবারই থাকে। শট তো তার হাতে কম নেই! অথচ দুরন্ত তারুণ্যের সেই চঞ্চলতাকে চাপা দিয়ে কী দিয়ে আশ্চর্য পরিমিতি বোধ তার। এত কম অভিজ্ঞতার পরও কী পরিণত মানসিকতা!
একটা ছেলের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিজ্ঞতা সামান্য। ‘এ’ দলের হয়ে বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ খেলেননি। টেস্ট অভিষেকের আগে মোটামুটি মানের বোলিং খেলার অভিজ্ঞতাও তেমন একটা নেই। সেই ছেলে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে ২৯২ মিনিট খেললেন। তৃতীয় টেস্টে ৪৪২ মিনিট। সেটিও ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন দুই কন্ডিশন নিউ জিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায়।
কিভাবে সম্ভব?
আমি ঠিক জানি না। ভেবে পাই না। আমি অভিভূত হতে পারি। বিস্মিত হতে পারি। মুগ্ধ হতে পারি। আপাতত ভালো লাগার সবটুকুই ভেতরটায় ঠাসাঠাসি করে আছে তাঁর ইনিংস দেখে।
দুই বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে দারুণ এক সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। যে ইনিংস দলকে নিয়ে গিয়েছিল ইতিহাস গড়ার মঞ্চে। এবার সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় জাতীয় দলের শ্বেতশুভ্র পোশাকে যে ইনিংসটি খেললেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেও তা স্থায়ী জায়গা পেয়ে গেল।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে তার ৭৮ আর ডারবানের এই ইনিংসের জিনগত বৈশিষ্ট্য একই। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, হার না মানা মানসিকতা, ফাঁদে পা না দেওয়ার সংযম, লড়াইয়ের তীব্র তাড়না এবং প্রশ্নাতীত নিবেদন। গোছানো পথে ইনিংস গড়ার শৃঙ্খলা। সংযম, ধৈর্য, উইকেট আঁকড়ে রাখা আর নিবেদনের আশ্চর্য গল্প যেন। সব মিলিয়ে আদর্শ টেস্ট টেম্পারমেন্ট।
অফ সাইডে বোলাররা ফাঁদ পেতে তাকে প্রলোভন দেখিয়েছেন। তিনি পা বাড়াননি। শট ছিল না তার? অবশ্যই ছিল। কিন্তু আরও বেশি ছিল নিয়ন্ত্রণ। জেদ। উইকেট না দেওয়ার তাড়না।
আরেকটা ব্যাপার ছিল স্পেশাল। তার ম্যাচ অ্যাওয়ারনেস। বোলার বুঝে খেলা, ফিল্ড প্লেসিং বুঝে খেলা, পরিস্থিতি বুঝে খেলা। অসাধারণ! কালকে দারুণ বোলিং করা সাইমন হার্মারকে আজকে প্রথম দুই ওভারেই দুটি চার ও একটি ছক্কা মেরেছেন। হার্মার তাতে আজকে আর চেপে বসতে পারেননি। ব্যাটসম্যান ঘিরে ছাতার মতো ফিল্ডিং সাজাতে পারেননি।
সেঞ্চুরির পর, বিশেষ করে মিরাজ আউট হওয়ার পর যখন তিনি দেখলেন যে এখন বাকি স্রেফ দুই লেজের ব্যাটসম্যান, নিজের ব্যাটিংয়ের আরেক রূপ দেখালেন তখন। হার্মারকে চার-ছক্কা, ভিয়ান মুল্ডারকে ওভারে চারটি চার। একটির চেয়ে আরেকটি ভালো শট। সেসব শটে পাওয়ার আছে, ক্লাস আছে, টাইমিং আছে, অথোরিটি আছে।
মুগ্ধ মার্ক নিকোলাস ধারাভাষ্যে বললেন, ‘হি ইজ নট অনলি আ গুড প্লেয়ার, বাট হি অলসো গট আ গুড ক্রিকেট ব্রেইন…’ সেঞ্চুরির পরের ব্যাটিংটুকু তার ইনিংসকে আরও স্পেশাল করে তুলেছে। ওপরে যেটা লিখেছি, শট তার হাতে আছে, তার পরও কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখেন নিজেকে!
শেষ ব্যাটসম্যান যখন ক্রিজে, ‘ক্যারিং দ ব্যাট থ্রু আ কমপ্লিটেড ইনিংস’ কীর্তি গড়ার হাতছানি ছিল তার সামনে। তিনি তা ভাবেননি একটুও। দলের জন্য খেলেছেন। লোয়ার অর্ডারদের আগলে রেখে রান যতটা সম্ভব বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন, তরুণ একজনের কী অসামান্য মানসিকতা!
তার টেকনিকের একটা ভালো ব্যাপার হলো, জটিল কিছু নেই। স্টান্স, ব্যাক লিফট খুব সিম্পল। যতটা সম্ভব শেষ পর্যন্ত বলে চোখ রাখেন, আই বলের নিচে এবং যতটা সম্ভব দেরিতে খেলার চেষ্টা করেন, ড্রাইভে ব্যাটের ফেস মেলে ধরতে চান। স্পিনে টার্নের বিরুদ্ধে পারতপক্ষে ব্যাট চালান না।বলতে পারেন, দক্ষিণ আফ্রিকার মূল পেস আক্রমণ ছিল না এখানে। সেটা সত্যি, তবে তারও তো সবে তৃতীয় টেস্ট এটি!
হ্যাঁ, ক্যারিয়ারের মাত্র শুরু। আরও অনেক কঠিন পরীক্ষা সামনে। তার ব্যাটিং নিয়ে এখন গবেষণা করবে প্রতিপক্ষ, অ্যানালিস্টরা কাটাছেঁড়া করবেন, শক্তি-দুর্বলতা বের হবে ক্রমে। ক্রিকেটে এসবের বাইরেও খারাপ সময় আসে। একটা দারুণ বল, একটা অসাধারণ ক্যাচ, একটা বাজে রান আউট, একটা আলগা শট, খারাপ সময় শুরু হতে পারে এবং খারাপ সময়ে কিছুই ঠিক হয় না। অনেক কিছু নিজের কন্ট্রোলেই থাকে না তখন।
কাজেই পরীক্ষার কেবল শুরু তাঁর। বলতে পারেন, এখনই এত মহাকাব্য লেখার কী আছে! হ্যাঁ, আরও চ্যালেঞ্জ আসবে। তিনি তাল মিলিয়ে উন্নতি করতে পারলে টিকবেন। নইলে ঝরে যাবেন। সেসব তার নিজের ওপর, দেশের ক্রিকেট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করবে। সবকিছু সময়ের হাতেই তোলা।
কিন্তু মাউন্ট মঙ্গানুই আর ডারবানে যে ইনিংস দুটি খেললেন, ক্রিকেটের সামান্যতম অনুসারী হলেও বোঝার কথা ইনিংস দুটির ওজন ও মাহাত্ম। স্পেশাল স্পেশাল ইনিংস, স্পেশাল এফোর্ট, স্পেশাল ট্যালেন্ট, স্পেশাল ব্রিড। খুব করে চাইব, দেশের ক্রিকেটের গড়পড়তার স্রোতে যেন কখনও তিনি গা না ভাসান। জয়ের জয়রথ যেন ছুটতে থাকে।