মাঝদরিয়ার অদম্য নাবিক

আউটসাইড এজে বলটা সরাসরি উইকেটের পেছনে মহেন্দ্র সিং ধোনির হাতে। ভারতীয় সমর্থকদের উল্লাস। কিন্তু পরক্ষণেই টিভি স্ক্রিনে দেখা গেল নো বল! ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে জাসপ্রিত বুমরাহর নো বলে বেঁচে যান ফখর জামান।

বাকি গল্পটা সবার জানা। এক নো বলে জীবন পেয়ে ফখর জামান জুড়ে দেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা পাকিস্তানের! এক নো বলেই পালটে যায় সবকিছু। শূন্য থেকে নায়ক বনে যান ফখর জামান। ক্রিকেট বিশ্বের সামনে আবির্ভাব হয় সম্ভাবনাময় এক তারকা ক্রিকেটারের!

ছোটবেলা থেকেই পাকিস্তান ক্রিকেটের অ্যাডাম গিলক্রিস্ট হবার স্বপ্ন দেখতেন। গিলক্রিস্টের মতো ব্যাটিং করতে চাইতেন ছোট থেকেই। পেশিতে শক্তিও ছিল প্রচুর। বলকে সহজেই বাড়ি মেরে দূরে পাঠাতে পারতেন ফখর।

খাইবারপাকতুনের মারদান নামক গ্রাম থেকে উঠে আসেন ফখর জামান! অনেক ভাল খেলার কারণেই পাড়ার ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ফখরকে! গ্রামের বাকিদের তুলনায় অনেক জোরে বল পেটাতে পারতেন তিনি। বড় ভাই আসিফ জামানের হাতে প্রচুর মার খেয়েছেন ক্রিকেটের জন্য। স্কুল ক্রিকেটেও দুর্দান্ত ছিলেন ফখর। স্কুল ক্রিকেটে ভাল খেলার জন্য নিজ গ্রামে বেশ পরিচিতি লাভ করেন তিনি। এমনকি অনেকেই বলতো, ‘ওর সাথে খেলো না, সে খুব দৃঢ় খেলোয়াড়।’

বাবা চাইতেন ছেলে কেতাবি শিক্ষায় ভাল করুক। কিন্তু তিনি হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার! মাত্র ১৭ বছর বয়সেই সংসারের ভার কাঁধে ওঠে ফখরের। ২০০৭ সালে পরিবারের আর্থিক অবস্থা তখন বেশ শোচনীয় ছিল। তখন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে নাবিক হিসেবে যোগদান করেন ফখর। এক বছর নেভিতে থাকার পর করাচিতে বদলি করা হয় ফখরকে।

মূলত সেখানেই তিনি নিজের স্বপ্ন পূরণের রাস্তাটা দেখতে পান। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় পাকিস্তান নেভি ক্রিকেটের কোচ নাজিম খানের সাথে! ক্রিকেট নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা জানানোর পর নাজিম খান তখন ফখরকে তাঁর অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে নেন।

নাজিম খানের অ্যাকাডেমিতে প্রথম ম্যাচে খেলতে নেমেই ফখর করেন ৩৭ রান। বেশ কয়েক ম্যাচে ভাল করার পর ফখরের প্রতিভা নজরকাঁড়ে নাজিম খানের। সেখান থেকে ফখরকে আজম খান ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে পাঠান তিনি! সেসময় তরুণ ক্রিকেটার গড়ে তোলার জন্য বেশ পরিচিতি ছিল আজম খান অ্যাকাডেমির।

আজম খানকেও নিজের প্রতিভা আর সামর্থ্য দেখিয়ে মুগ্ধ করতে খুব বেশি সময় নেননি ফখর। আসগর আলী শাহ স্টেডিয়ামে আন্ত:জেলা অনূর্ধ্ব ১৯ ম্যাচে সেঞ্চুরি করে তাক লাগিয়ে দেন তরুণ ফখর। আজম খান উপলব্দি করলেন ফখরের জায়গা নেভিতে নয়, ক্রিকেটে হওয়া উচিত।

এরপরই ফখরকে পাকিস্তান নেভি ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন আজম খান। ফখরের পরিবার অবশ্য এই কথা শুনে কিছুটা বিষন্ন ছিলেন। সরকারি চাকুরি ছেড়ে ক্রিকেটে আসাটা মোটেও মেনে নিতে পারছিল না ফখরের পরিবার। কিন্তু আজম খান ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যান এবং পরবর্তীতে তিনি সফল হন। তাঁর আবেদন পাকিস্তান নেভিতে গ্রহণ করা হয়। ২০০৮ সালে ফখরকে পাকিস্তান নেভি ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷

তাঁকে সতীর্থরা ডাকতেন ‘ফৌজি’ নামে।

৯৫ মাইল ঘন্টায় বল করা বোলিং মেশিন দিয়ে পুল শট অনুশীলন করতেন ফখর। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্রিকেট অনুশীলন করতেন তিনি। কিন্তু পারিবারিক সমস্যা আর মাঝে মাঝে ব্যাট খারাপ পারফরম্যান্সে অনেক বার তিনি ক্রিকেট ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে কোচ আজম খানের জন্য সেটা পারেননি।

ফখর চাচ্ছিলেন যত দ্রুত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সুযোগ পাওয়া যায়। ভেবেছিলেন নিজের অঞ্চলে ফিরে গেলে সেখান থেকে দল পাওয়াটা হয়তো আরও সহজ হবে! করাচিতে থাকলে সুযোগ পেতে কষ্ট হবে এমন ভাবাটাই যেনো তাঁর ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি হতে চলেছিলো।

ফখরের করাচি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শুনে কোচ আজম খান বেশ রাগও হয়েছিলেন। মাঝে ৬ মাস ফখরের সাথে যোগাযোগ ছিল না আজম খানের। এরপর ২০১১ সালে ফখর পুনরায় করাচিতে আসেন। এর দুই বছর পরই ২০১৩ সালে ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে নেভির চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।

পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) প্রথম সিজনের আগে ইমার্জিং ক্যাটাগরিতে ড্রাফটে রাখা হয় ফখরকে। কিন্তু সেখানে তিনি দল পাননি! পরবর্তীতে পাকিস্তান কাপে ইউনুস খানের অধিনায়কত্বে খাইবার পাখতুনওয়ার হয়ে ৫৯.০৪ গড়ে ৫ ম্যাচে ২৯৭ রান করেন! এরপর আহমেদ শেহজাদের সাথে ওই টুর্নামেন্টেই ওপেনিং করার সুযোগ পান তিনি। এবং পুরো টুর্নামেন্টেই দূর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন ব্যাট হাতে। ফাইনালে ১১১ বলে ১১৫ রানের ইনিংসের মাধ্যমে ম্যাচ সেরার পুরস্কারও যেতেন ফখর!

এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তরুণ সম্ভাবনাময় এই তারকাকে। ২০১৭ সালে লাহোর কালান্দার্সের হয়ে পিএসএল খেলার সুযোগ পান ফখর। ওই বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় এই ওপেনারের। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একই বছর ওয়ানডে অভিষেক।

ওয়ানডে অভিষেকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ম্যাচে ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে টানা দুই ফিফটি করেন ফখর। এরপর ফাইনালের সেই ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি! পরের বছর ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম পাকিস্তানি ব্যাটার হিসেবে গড়েন ডাবল সেঞ্চুরির কীর্তি। ওয়ানডেতে ধারাবাহিকভাবেই রান করেছেন ফখর। ২০২১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডেতে জোহানেসবার্গে খেলেন ১৯৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস! পরের ম্যাচেই সুপারস্পোর্টস পার্কে চড়ে দেন আরেক সেঞ্চুরি।

টি-টোয়েন্টিতেও গেল বছর বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি ফিফটি করেন ফখর। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে দলের নিয়মিত মুখ তিনি। ব্যাট হাতে মাঝে কিছুটা নিষ্প্রভতা দেখা গেলেও এখন তিনি চিরচেনা আগ্রাসী রূপেই খেলে যাচ্ছেন।

ধৈর্য্য আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষ তাঁর স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছাতে পারে এর জ্বলন্ত উদাহরণ – ফখর জামান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link