স্টারডমহীন গ্ল্যাডিয়েটর

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে যে একটি ভূমিকায় খেলা ক্রিকেটারের কখনোই অভাব কখনোই হয় নি, তা হল বাঁ-হাতি স্পিনার। একসময়কার মোহাম্মদ রফিক থেকে শুরু করে মাঝের এনামুল হক জুনিয়র,আব্দুর রাজ্জাক, সোহরাওয়ার্দী শুভ, ইলিয়াস সানি কিংবা বর্তমানের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব হাল হাসান সবাই খুব গৌরবের সাথে বাংলাদেশ দলকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। সেই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেই হয়তো বর্তমানে বাংলাদেশ দলকে প্রতিনিধিত্ব করছেন আরেক বামহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম।

বর্তমানে বাংলাদেশ দলে তারকা খেলোয়াড় এর কমতি নেই। নিজের দিনে যে কেউ একাই একটি ম্যাচ জিতিয়ে আনতে পারে। কিন্তু ক্রিকেট দলগত খেলা। দলের ১১ জনেরই কোনো না কোনো ভূমিকা দলের জয়ে থাকেই। ১১ টি তারার আলোতেই দলের জয় নিশ্চিত হয়।

কিন্তু, বাংলাদেশ দলের জয়ে অন্যসব তারকাদের নাম যতটা উচ্চারিত হয়, ঠিক তার বিপরীত ভাবেই আরও একটি তারকার নাম প্রায়ই অনুচ্চারিত রয়েই যাই। সেই তারকাটি হলেন তাইজুল ইসলাম। যিনি দলের জয়ের ভূমিকায় অনেক সময় প্রধান ভূমিকা পালন করেও বেশিরভাগ সময়েই রয়ে যান পাত প্রদীপের আলোর বাইরে।

১৯৯২ সালে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির সাত তারিখে বনলতা সেনের নাটোরের সদর উপজেলার পিপরুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তাইজুল। বাবা এসকান্দার আলী ও মা তাসলিমা বেগমের আদরের ‘রাঙা’(ডাকনাম)ই আমাদের তাইজুল।

পৃথিবীর সব বাবা-মাই সন্তানের জন্য হৃদয়ের ও সাধ্যের সবটুকু নিংড়ে দিতে চান, তাইজুলের বাবা মা ও দিয়েছিলেন। অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তবু্ও ছেলেকে কখনোই কষ্ট করতে দেননি। ছেলের স্বপ্ন ছোট থেকেই আকাশ ছোয়া ছিল, তারা কখনোই সেই স্বপ্নের পথে বাধা হননি, বরং সেই স্বপ্নের সারথী হয়েছেন। ছেলেকে বলেছেন,বামন হয়েই চাঁদ ধরতে হবে।

নাটোরের একমাত্র ক্রিকেটার হয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলছেন, এসকান্দার আলীর দুই মেয়ের পরে হওয়া এই ছেলেটা। তাইজুল হতাশ করেন নি কাউকেই। না বাবা মাকে, না জাতীয় দলকে।

জাতীয় দলের হয়ে যে টেস্টের সেরা বোলিং ফিগারটি এখন অবধি তো এই ‘রাঙা’রই দখলে।শুধু কি তাই? দেশের হয়ে ওয়ানডেতে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করে বাবা মায়ের পাশাপাশি দেশ, জাতিকেও করেছেন গৌরবদীপ্ত।

ক্রিকেট হওয়ার পথটা তাইজুলের কখনোই মসৃণ ছিল না। বাবার ছিল ছোট কাপড়ের ব্যবসা।প্রতি হাটবারে এক হাট থেকে অন্য হাটে বাবা কাপড় বিক্রি করতেন। এই কাজ করে পাচজনের সংসার চালানো একরকম কষ্টকর ব্যাপার ছিল। তবুও এসবের ভেতরেই ছেলের খেলার যাবতীয় সরঞ্জাম বাবা কিনে দিতেন।

১৪ বছর বয়সে, ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে তাইজুল ক্রিকেটের অনুশীলন করতে বিভাগীয় কোচ শানু স্যারের কাছে যেত। নাটোর থেকে রাজশাহীর ভাড়া ৫০-৬০ টাকা। যা দৈনিক তার বাবা বহন করত। এমনও অনেক দিন গেছে এসকান্দার আলীর বাড়িতে চাল ছিল না, তবুও তাইজুলের প্রাকটিসে যাওয়া বন্ধ হয়নি।

এভাবেই তাইজুলের শুরু। ২০০৪ এ নাটোর জেলার অনূর্ধ্ব-১৩ থেকে শুরু এরপর আর তাইজুল কে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। পর্যায়ক্রমে জেলা থেকে বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ খেলেন তাইজুল এবং রাজশাহী ডিভিশনের হয়ে নিয়মিত ভাবে ভাল পারফরম্যান্স করতে থাকেন।

এপ্রিল ২০১১, মাত্র ১৯ বছর বয়সে রাজশাহী বিভাগের হয়ে বরিশাল বিভাগের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাইজুলের অভিষেক ঘটে। ব্যাটিংয়ে তেমন কিছু না করতে পারলেও ম্যাচে তিনি ৬ উইকেট লাভ করেন। তাঁর দল ও ১১৬ রানে জয়লাব করেন। তবে জাতীয় দলে ঢুকতে তাইজুল বেছে নেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগকে (বিসিএল)।

২০১৪ সালে ওই টূর্নামেন্টে ৪ ম্যাচে ৩৭ উইকেট পান তাইজুল। যা জাতীয় দলের নির্বাচক দের চোখ এড়ায়নি। বলাবলি হচ্ছিল, মোহাম্মদ রফিকের যোগ্য উত্তরসুরী পেয়ে গেছে বাংলাদেশ।

আগস্ট, ২০১৪! বাংলাদেশ দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তার নাম ঘোষণা করা হয়। প্রথম টেস্টেই একাদশেও সুযোগ পেয়ে যান। শুধুই কি তাই! অভিষেক টেস্টেও দলের বিবর্ণ পারফরম্যান্স এর মধ্যেও নিজে একাই পাচ উইকেট পাওয়ার মাধ্যমে নিজের অভিষেক কে রাঙিয়ে রাখেন নাটোরের রাঙা।

নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৪। এর পরের সিরিজটর তাইজুলসহ কোনো ক্রিকেট প্রেমীরই ভোলার কথা নয়। জিম্বাবুয়েকে আতিথ্য দিচ্ছিল বাংলাদেশ। সাকিব তো বরাবরের মতোই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ভয়ংকরী ছিলেন। কিন্তু এবার সাকিবকে ছাপিয়ে শিরোনামে আরেকজন।

এক ইনিংসে ৩৯ রানের বিনিময়ে আট উইকেট নিয়ে তাইজুল বাংলাদেশি বোলারদের সেরা বোলিং ফিগার এর রেকর্ড নিজের নামে করে নেন,যা এখনো তারই আছে। শুধু দেশি নয়। তাইজুলের ৮/৩৯ বোলিং ফিগার  পুরো বিশ্বে বাম হাতি স্পিনার দের মধ্যে তৃতীয় সেরা। তার ওপর রয়েছেন কেবলমাত্র শ্রীলঙ্কার রঙ্গানা হেরাথ এবং ইংল্যান্ডের জনি ব্রিগস।এই সিরিজেই  মিরপুরে তাইজুল দলের সবচেয়ে দরকারি সময়ে ৩২ রানের এক অপরাজিত ইনিংস খেলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দলের ৩ উইকেটের জয় নিশ্চিত করেন।

পরের ওয়ানডে সিরিজটা শুরু হয় সেবার ডিসেম্বরে। তাইজুল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে নিজের অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করে বিরল কীর্তি স্থাপন করেন। তিনি একে একে জিম্বাবুয়ের পানিয়াঙ্গারাকে বোল্ড, জন নিয়ুম্বুকে এলবিডব্লিউ, এবং টেন্ডাই চাতারাকে বোল্ড করে নিজের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন।

ম্যাচে তিনি ৭-১১-৪ লাভ করেন। তাইজুল অভিষেকের এই ওয়ানডর পর দল থেকে ব্রাত্য হয়ে পরলেও, টেস্টে বাংলাদেশের স্পিন এটাকের অন্যতম কান্ডারী এবংং  নিয়মিত সদস্য। ২০১৬ সালে মিরাজের অভিষেকের পর,সাকিব তাইজুল এবং মিরাজ মিলে বাংলাদেশের স্পিনত্রয়ী গঠন করে যা নিজেদের ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার,ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দলকে টেস্টে হারায়।

২০১৯ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তাইজুল আরও একটি রেকর্ড করেন।সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে টেস্টে ১০০ উইকেট লাভের রেকর্ড নিজের নামে করে নেন। যেটি সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্পিন কিংবদন্তি মোহাম্মদ রফিক এর নামের পাশে ছিল। ৩৩ ম্যাচে ১০০ উইকেট। যা পরবর্তীতে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ২৮ ম্যাচে ১০০ উইকেট নিয়ে নিজের নামে  করে নেন। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯-এ তাইজুল সেই রেকর্ড ভেঙে মাত্র ২৫ ম্যাচে  ১০০ উইকেটের রেকর্ড নিজের নামে করে নেন।

সচরাচর বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণের নেতৃত্ব দেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু বিভিন্ন সিরিজে সাকিবের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ দলকে বোলিংয়ে তার শূন্যস্থান পূরনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তাইজুল ইসলাম। অনেক সময় দলের অন্যান্য দের পারফরম্যান্সর কারণে দল হারলেও বেশিরভাগ সময়েই তাইজুল নিজের জায়গাতে জ্বাজ্জল্যমান ছিলেন।

আবার দলের বেশিরভাগ জয়ের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।কখনো বা ব্রেক থ্রো এনে দিয়ে কখনও বা এক প্রান্তে ইকোনমিক্যাল বোলিং করে। তাইজুল ইসলামের সবচেয়ে ভাল দিকটি হল,টানা বোলিং করে যাওয়া এবংং একই জায়গায় বল ফেলা তার শক্তির জায়গা। যা বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যান দের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যাতে করে তারা অন্যান্য বোলারকে আক্রমণ করতে গিয়ে আউট হয়। ২০১৪ সালে অভিষেক হলেও ওয়ানডে দলে এখন অব্দি নিজের জায়গাটা পোক্ত করতে পারেননি।

তাইজুল ইসলাম কখনোই লাইমলাইটে আসতে চাননি। তিনি বরাবরই মৃদুভাষী, নিচু স্বরে কথা বলেন। সাথে হালকা লাজুক স্বভাবেরও। কিন্তু খেলার মাঠে ততটাই কার্যকর। নিজের কাজটা তিনি করে যান সততার সাথে। নাটোরের ‘রাঙা’র সামনে বাকি অনন্ত পথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link