মিনিট খানেক বাকি। স্রেফ কয়েকশ সেকেন্ড। বিশ্বকাপ খেলার সুযোগটা ক্রমশ আবছা হচ্ছে চোখের সামনে। ঠিক তখন এক পেনাল্টি। আর দলকে বিশ্বকাপের বন্দরে ভেড়ানোর দায়িত্বটা সেদিন এসে পড়েছিল মোহাম্মদ সালাহের উপর। ততক্ষণে গোটা স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে একটা উল্লাসের তীব্র বাতাস ছুঁয়ে গেল মিশরের ডাগআউট।
মিশরের প্রতিটা মানুষের স্বপ্নের দায়ভার সেদিন ছিল মোহাম্মদ সালাহের কাঁধে। তিনি সেদিন কথা রেখেছিলেন। আনন্দের অশ্রুজলে সেদিন ভাসিয়েছিলেন তিনি গোটা মিশরকে। সেদিন বা-পায়ের এই উইঙ্গার গোল ঠিকই আদায় করেছিলেন। সেদিন সালাহের চোখটাও ভিজে গিয়েছিল। সমুদ্র জল সেদিন গড়িয়েছিল সবুজ ঘাসে।
স্বপ্ন যাত্রার সারথী মোহাম্মদ সালাহ জন্মেছিল ১৫ জুন ১৯৯২ সালে। বাবা-দাদারা খেলতেন একসময় ফুটবল। এই স্থানীয় ক্লাব পর্যায়ে। ডিএনএ থেকে তিনি পেয়েছিলেন তবে আঁকড়ে তিনি একমাত্র ধরতে পেরেছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি পেশাদার ফুটবলের সাথে যুক্ত হয়ে যান।
দেশীয় ক্লাব এল মোখাওলুনের অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে মাঠ মাতান তিনি। সম্ভাবনাময় তিনি ছিলেন। সে সম্ভাবনা যেন চোখে পড়ে সুইজারল্যান্ডের ক্লাব এফসি বাসেলের। বিশ বছরে সালাহ তখন মিশর থেকে পা রাখেন ইউরোপের ফুটবলে। এ যেন অন্য এক দুনিয়া। এখানটার জাকজমক যেন হার মানায় সবকিছুকে। তবুও নিজের স্বকীয়তা হারালেন না।
বরং তিনি যেন আরও নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ খুঁজলেন। নিজেকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করার সকল কাজই করলেন তিনি। উদীয়মান তারকা ফুটবলার হিসেবে তিনি ইউরোপে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তাইতো ইংলিশ পরাশক্তি চেলসি তাকে নিয়ে আসে। তবে সালাহের ক্যারিয়ারটা যেন লন্ডনে এসে থমকে যায়। কোচ হোসে মৌরিনহোর সময় তিনি যেন রীতিমত বেঞ্চে বসিয়ে কাটিয়েছেন।
তিনি ঠিক ক্লাবের একাদশে জায়গা করে নিতে পারছিলেন না। ক্লাবও ঠিক বুঝতে পারছিল না এমন একজন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়কে বসিয়ে রাখা খুব একটা কাজের কাজ হচ্ছে না। তাই তাকে ধারে খেলতে পাঠানো হয় ইতালির ক্লাব ফিরোন্টিনাতে। সেখানে খেলার সময় শেষ হলে আরেক ইতালিয়ান ক্লাব রোমাতে খেলেন তিনি ধারে। পরে অবশ্য রোমা তাকে কিনে নেয়।
রোমার সেই খয়েরী জার্সিতে নিজের স্বরুপে যেন ফেরেন মোহাম্মদ সালাহ। দুই মৌসুম খেলেন তিনি ক্লাবটির হয়ে। দৃষ্টিনন্দন পারফরমেন্সে তিনি মুগ্ধ করেন সবাইকে। এরপর আবার সেই ইংল্যান্ড থেকেই ডাক আসে তাঁর। এবার ক্লাবটা লিভারপুল। আর সেটাই সালাহের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। আর লিভারপুলই যেন সালাহকে একজন ‘বিস্ট’ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দেয় পুরো বিশ্বকে।
রীতিমত সম্ভাবনার সব খোলস ছেড়ে তিনি গায়ে জড়ান সময়ের সেরা তারকার তকমা। তিনি যেন অবশেষে খুঁজে পেলেন সাফল্য ছোঁয়ার সিঁড়ি। কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের আক্রমণের অন্যতম আস্থাভাজন কান্ডারি বনে যেতে খুব একটা সময় নেননি সালাহ। লিভারপুলের প্রত্যাবর্তনের সাথে সমানতালে পরিবর্তন হতে থাকেন সালাহ। সালাহর-লিভারপুল এক মধুর সম্পর্ক বনে গেল।
সাদিও মানে ও রবার্তো ফিরমিনোকে সঙ্গে নিয়ে সময়ের সেরা ত্রয়ী গঠন করে প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেঙে চুরমার করতে শুরু করেন সালাহ। লিভারপুলের যত অর্জন সবকিছুতেই যেন রয়ে যায় তাঁর অবদান। হয়ত আরও একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা হয়ে যেত লিভারপুলের যদিনা ২০১৮ সালে সালাহ ইনজুরি আক্রন্ত হয়ে মাঠের বাইরে চলে না যেতেন ফাইনালের দিন।
কেননা সে সময়টাই তো ছিল সালাহ। সালাহ তো সে সময় ছিলেন অন্যরকম এক বিধ্বংসী ফর্মে। আফসোসটা আরও একবার বেড়ে যায় ২০২১-২২ মৌসুমে। চারটি ট্রফি জেতার হাতছানি থাকলেও, স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় সালাহের। ম্যানচেস্টার সিটির কাছে শেষ দিনে গিয়ে হারতে হয় লিগ শিরোপা। অন্যদিকে আবারও রিয়াল মাদ্রিদের কাছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হারার স্বাদ হজম করতে হয়ে মিশরের এই মহাতারকার।
ব্যালন ডি’অর জয়ের দৌড়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলেন তিনি। তবে সালাহ নিশ্চয়ই আগামী মৌসুমেই আবার চেষ্টা করবেন ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিটা ভারি করবার। তাছাড়া দলগত অর্জনের খাতাটাও তিনি নিশ্চয়ই আরেকটু ভরাট করতে চাইবেন।
সেটা পারবেন কি না তা হয়ত সময় বলে দেবে। তবে তিনি চিরকাল লিভারপুলের একজন কিংবদন্তি হওয়ার পাশাপাশি ফুটবলের একজন ধ্রুব তারা হয়ে রইবেন।