‘যারা আমাকে স্যার বলে, লর্ড বলে তারা আমাকে এখানে নিয়ে আসে নি। এখানে আসতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে’ – চলতি বছরের শুরুর দিকে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর একটি ইন্টারভিউতে কথা গুলো বলেছিলেন মোহাম্মদ মিঠুন। অনলাইনে ক্রমাগত ট্রলের শিকার হওয়া নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে এসব বলেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে সমালোচনা আর ট্রল মিশে আছে একেবারে অন্তরঙ্গ ভাবে। তারপরও মোহাম্মদ মিঠুনের ভাগ্যে এসবের দেখা একটু বেশি মিলেছে। বলতে গেলে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ যেন মিঠুনের সমার্থক হয়ে উঠেছে৷
কুষ্টিয়ার ছেলে মোহাম্মদ মিঠুনের বেড়ে উঠা বিকেএসপি-তেই। আর সেখানে পড়াকালীন অবস্থায় তাঁর নাম ছড়িয়েছে ‘প্রডিজি’ হয়ে। এত বড় উপাধি জুড়ে গিয়েছিল নামের সাথে, আর নিজের সাথে জুড়েছিলো পাহাড়সম প্রত্যাশা। শুরুটা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে, আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে লম্বা ইনিংস খেলার সামর্থ্যের জন্য দেশব্যাপী নাম ছড়িয়েছিলো তার।
পারফরম্যান্স ঠিকঠাক করে গেলেও ধারাবাহিকতার একটা অভাব ছিল মিঠুনের ব্যাটে। তাই হয়তো ২০০৬-০৭ থেকেই ঘরোয়াতে খেললেও জাতীয় দলে প্রথম ডাক পান ২০১৪ সালে। সুখকর হয়নি অভিষেক, দল থেকে বাদ পড়েছেন।
শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ বিরতি কাটিয়ে দলে ফিরেন ২০১৮ সালের এশিয়া কাপ দিয়ে লাইমলাইটে আসেন মোহাম্মদ মিঠুন৷ প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে খেলেন ৬৩ রানের মূল্যবান ইনিংস। একই টুর্নামেন্টে অলিখিত সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রায়ই একই পরিস্থিতিতে আবারো ৬০ রান করে দলকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করেন।
এরপরের নিউজিল্যান্ড সফরেই যখন দলের বাকি ব্যাটসম্যানদের যেখানে নাভিশ্বাস উঠেছিল সেখানে পরপর দুই ম্যাচে দুই ফিফটি মিঠুনের। সবমিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে চমৎকার কিছু পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস আছে তাঁর। তবে এমন হাতেগোনা কয়েকটা ভাল ইনিংস দিয়েই তো একজন ব্যাটসম্যানকে কখনো মানসম্মত বলা যায় না।
লিটন, শান্তদের মত অমিত প্রতিভা নিয়ে আসেননি । বিধাতা প্রতিভার ভান্ডার থেকে যৎসামান্যই বরাদ্দ করেছিলেন। কেউ কেউ হয়তো ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে আসেনা, কিন্তু এই প্রতিভা অভাবকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সক্ষমতা সবার থাকেনা। মিথুন জানিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ, হয়তো পেরে উঠতে পারেননি।
আর সেখানেই শুরু রাজ্যের ট্রল, মিম আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। টি-টোয়েন্টিতে পারেননি মানানসই ব্যাটিংটা করতে পারেননি। টেস্টেও মাটি কামড়ানো ব্যাটিং আয়ত্তে নেই তার। খুবই সাদামাটা একজন ওয়ানডের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এই টানাপোড়েনে টিকতে পারেননি, ঘটেছে ছন্দপতন।
ঘরোয়া ক্রিকেটেও বরাবরই পারফর্ম করেন মিঠুন। আহামরি নয়, তবে অন্য অনেকের চেয়ে ভাল করেন এই ব্যাটসম্যান। কিন্তু ট্রলের শিকার হওয়াতে তিনি সবার আগেই। মোহাম্মদ মিঠুন নামটা নিয়ে ট্রল করা যতটা সহজ, ততটা বোধহয় বাইশ গজে ব্যাট ধরা সহজ নয়।
একজন খারাপ খেললে তার সমালোচনা হয়, এটি বিরাট কোহলি কিংবা স্টিভ স্মিথ এর জন্যও সত্য। কিন্তু বুলিং আর সমালোচনা যে এক নয় তা বুঝতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের এখনো ঢ়ের বাকি।
মিথুনের ওয়ানডেতে ব্যাটিংগড় ২৭ এর একটু বেশি, টেস্টে সেটা ১৮ আর টি২০ তে ১০! কিন্তু মজার ব্যাপার তার পারফরম্যান্সের সাথে ব্যঙ্গবিদ্রুপের সম্পর্ক খুব কমই। বাংলাদের ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) মিথুনের ডাবল সেঞ্চুরি করার খবরেও দাঁত বের করে হাসি দিয়ে আর হাহা প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আমরা যেন আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধিকেই ব্যঙ্গ করেছি।ট
তাই সামাজিক মাধ্যমে যতই হাসাহাসি হোক, নির্বাচকরা ভুল করেননি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ফর্মে ফেরা মোহাম্মদ মিথুনকে আরেকবার সুযোগ দিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ এ’ দলের স্কোয়াডে নাম আছে তাঁর। সাধারন সদস্য নয়, দলটির অধিনায়কও তিনি।
ক্যারিবীয় দ্বীপের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়ার আগে যখন সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন মিথুন। তখন অন্যসব কিছুর সাথে একটা বিশেষ প্রশ্নও করা হয়েছে তাকে। এই যে এত এত ট্রল, বিদ্রুপ; কিভাবে এসব দেখেন মিথুন?
সদা হাস্যজ্জ্বল মিথুন জবাবটা দিয়েছেন হাসিমুখেই। তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মাতামাতি বেশি হয়। তাই সমালোচনার পরিমাণও বেশি। এসব হ্যান্ডেল করতে না পারলে আমি ক্রিকেট খেলতে পারবো না। তাই এসব হ্যান্ডেল করার জন্য মেন্টালি স্ট্রং হতে হবে আমাকে।’
সর্বশেষ জাতীয় দলে খেলেছেন অনেক দিন আগে। লম্বা এই বিরতিতে নিজেকে মানসিকভাবে আরো দৃঢ় করে তুলেছেন বলে জানান এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। আপাতত নতুন দায়িত্ব হাতে এসেছে, বাইরের অন্যসব কথা মাথায় না এনে, দায়িত্বের দিকেই মনোযোগ দিতে চান তিনি।
মিঠুনদের বিপক্ষে করা অনাকাঙ্ক্ষিত ‘সাইবার বুলিং’ সহজে থামানো যাবে না। হঠাৎ করে এর মাত্রা কমবে এমনটা আশাও করা যায় না। তবে প্রশ্ন থেকে যায় একটা। ক্রিকেটের পরিসংখ্যানে মিঠুনের অবস্থান মোটেই উঁচুতে নয় – কিন্তু কতটা নিচুতে সেটা জানা আছে? সেটা জানা থাকলে উপহাস করতে সুবিধা হয় না?