ব্রাজিলিয়ানদের কাছে তিনি পেলের চেয়েও ভালো ফুটবলার, আদুরে, অনেক বেশি কাছের। ভালোবেসে তাঁকে ডাকেন ‘আলেগ্রিয়া ডস পোভো’ নামে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘জনতার আনন্দ’। বলা হচ্ছিল তর্কসাপেক্ষে ব্রাজিলের ইতিহাসের সেরা ফুটবলার গারিঞ্চার কথা।
অথচ প্রথম দর্শনে তাঁকে ফুটবলার মনে করবার কোনো জো নেই। ডান পায়ের পাতা ভেতরের দিকে বাঁকানো, বাঁ পায়ের পাতা বাইরের দিকে। এক পা আবার অন্য পায়ের চাইতে ছয় সেন্টিমিটার বড়। পোলিও’র করাল থাবায় মেরুদণ্ডটাও ঠিক সুগঠিত নয়, অনেকটা ইংরেজি এস অক্ষরের মতো। রিও ডি জেনিরোর পাও গ্রান্ডেতে জন্ম নেয়া গারিঞ্চার ছেলেবেলা কেঁটেছে চরম দারিদ্রতা, কটাক্ষ আর অবহেলায়।
বাবা-মা তাঁর নাম রেখেছিলেন ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো ডস সান্তোস। তাঁর নাম ম্যানুয়েল থেকে গারিঞ্চা হবার পেছনেও আছে বঞ্চনার ইতিহাস। চার বছর বয়সে একবার ছোটো একটি পাখি ধরে এনে দেখিয়েছিলেন বড় বোন রোজাকে। বোন উপহাস করে বলেছিলেন, ‘পাখিটা ঠিক তোমার মতোই, উড়তে জানে। কিন্তু কোনো কাজের না। পাখিটার নাম গারিঞ্চা।’
রোজা কি তখন ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন তাঁর নিষ্কর্মা ভাইটা একদিন এই নামেই পুরো বিশ্ব মাতাবে।
জীবনের সমস্ত দুঃখ, বিষাদ, অবহেলা সবকিছু তিনি ভুলে যান বল পেলে। এক নিমিষে হয়ে ওঠেন জাদুকর, বল পায়ে ছুঁটে যান তরঙ্গের মতো। ফুটবল নিয়ে তাঁর মতো আনন্দ দর্শকদের কেবল ম্যারাডোনাই দিতে পেরেছেন। ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা এই নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও, গারিঞ্চাই ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ড্রিবলার এই নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেন না।
গারিঞ্চাকে সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করেন উরুগুয়ের বিখ্যাত ক্রীড়াসাংবাদিক এদুয়ার্দো গ্যালেয়ানো। তাঁর ভাষায়, ‘গারিঞ্চা মাঠে থাকা মানেই মাঠ হয়ে যায় সার্কাস রিং, বল হয়ে যায় অনুগত পশু আর সে মাস্টার। গারিঞ্চা বলকে পোষ মানিয়ে এমন সব কীর্তি শুরু করে দর্শকদের পাগল হবার জোগাড় তাতে।’
গারিঞ্চার ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৫১ সালে, বোটোফোগো’র হয়ে। ট্রায়ালের প্রথম দিনই বল পায়ে নাস্তানাবুদ করেন বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান লেফটব্যাক নিল্টন সান্তোসকে। পরে সান্তোসই ক্লাব কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন দ্রুত গারিঞ্চাকে সই করানোর জন্য। বোটোফোগো’র হয়ে গারিঞ্চার অভিষেক হয়েছিল স্বপ্নের মতো। ২-১ গোলে হারতে থাকা অবস্থায় কোচ তাঁকে মাঠে নামান।
এরপরই শুরু হয় গারিঞ্চা ম্যাজিক, অভিষেকেই দারুণ এক হ্যাটট্রিক করে দলকে জেতান ৬-৩ গোলে। ১৯৫৭ সালে দলকে জেতান স্টেট চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা। বোটোফোগো’র হয়ে ২৩৮ ম্যাচে করেন ৮৪ গোল। মাঝে করিন্থিয়াস, ফ্ল্যামেংগোতে খেললেও ১৯৭২ সালে অবসর নেন স্থানীয় ক্লাব ওলারিয়ার হয়ে।
১৯৫৮ বিশ্বকাপে পেলের পাশাপাশি ব্রাজিল দলে জায়গা পান গারিঞ্চা। সেখানেও আরেক কাণ্ড! বিশ্বকাপ শুরুর দশ দিন আগে ফিওরেন্টিনার বিপক্ষে এক ম্যাচে তিন ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষককে কাঁটিয়ে গোল না করে গোলমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্য ডিফেন্ডারদের আসার জন্য। ডিফেন্ডার এলেন, গারিঞ্চা তাঁকে কাঁটালেন এবং গোল দিলেন। ব্যাপারটা ভালোভাবে নেননি ব্রাজিল কোচ ফিওলা, ফলস্বরূপ বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে মাঠে নামাননি গারিঞ্চাকে।
সুযোগ পান গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে, সেই ম্যাচেই প্রথমবার পেলে-গারিঞ্চাকে একসাথে দেখার সুযোগ পায় পুরো বিশ্ব। ম্যাচের প্রথম তিন মিনিটেই এমন সব কীর্তি করেন দুজনে মিলে, লেভ ইয়েশিন পর্যন্ত বুঝতে পারছিলেন না কি হচ্ছে মাঠে। সেই তিন মিনিটকে বলা হয় ‘গ্রেটেস্ট থ্রি মিনিটস অব ফুটবল হিস্ট্রি’। এরপর ওয়েলস, ফ্রান্স গেঁড়ো কাঁটিয়ে ফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি হয় সুইডেনের।
ফাইনালে সুইডেনকে ৫-২ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বজয়ের আনন্দে মাতে ব্রাজিল। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ যদি হয়ে থাকে পেলে-গারিঞ্চার, তবে ১৯৬২ বিশ্বকাপ ছিল গারিঞ্চার অমরত্ব প্রাপ্তির আসর। পেলের ইনজুরিতে দলকে একহাতেই করান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ব্রাজিলের হয়ে ৫০ ম্যাচে করেন ১২ গোল। পেলে-গারিঞ্চা একসাথে মাঠে নেমেছেন এমন কোনো ম্যাচে কখনো হারেনি ব্রাজিল।
প্রতিভার অবহেলায় গারিঞ্চার তুলনা কেবল তিনি নিজে। প্রতিভাবানরা বোধকরি এমনই হন, খামখেয়ালি-উদাসীন। প্রাকটিসে আসেন না, কোচের ট্যাকটিকসে মনোযোগ নেই। পেলে যেখানে নিজেকে প্রকাশ করেছেন আইকন হিসেবে, গারিঞ্চা সেখানে আকন্ঠ ডুবে থাকতেন নারী আর মদে। তাঁর বৈধ সন্তানের সংখ্যা ১৩।
শোনা যায়, সারা রাত মদ খেয়ে মাঠে নামতেন আবার ড্রেসিং রুমে ফিরেই মদ খেতেন। একাকী, নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য অবস্থায় মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ১৯৮৩ সালে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গারিঞ্চা। মারাকানা থেকে পার গ্র্যান্ডেতে যাবার সময় তাঁর শবযাত্রার অংশ নিয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ। তাঁর সমাধিতে লেখা আছে, ‘এখানে ঘুমিয়ে আছে এমন একজন , যে ছিল মানুষের খুশির কারণ – মানে গারিঞ্চা।’