দুনিয়া বানানেওয়ালে…

১.

কাকভোরের কলকাতা। শহর তখন সবে পাশ ফিরছে। সদ্য দাপুটে অধিনায়কের নেতৃত্বে দোর্দণ্ডপ্রতাপ অস্ট্রেলিয়াকে মাটি ধরানো গেছে শেষমেশ। চায়ের গেলাসে আলতো চুমুক, কিছু প্রাত:কালীন আড্ডার তোড়জোড়।

ইতোমধ্যে সামনের গলির মোড়ে খানিক জটলা, কাছে গিয়ে উঁকিঝুকি দিতে তার অর্থ উদ্ধার হল। ব্যাপার গুরুতর। খবরের কাগজের আট নম্বর পাতায় বাংলা হরফের যা হেডলাইন তার প্রকৃত অর্থ এই যে- ‘সবুজ গালিচার উইম্বলেডনের অবিসংবাদী নায়ক পিট সাম্প্রাসকে ওই সবুজ উইম্বলেডনেই পর্যুদস্ত করেছে বছর উনিশের এক তরতাজা তরুণ।’

২.

২০১৯। কেটে গেছে ১৮ বছর। এর মধ্যে বিগত পাঁচ বছর (২০১২-২০১৬) ফেডেরার কোনও গ্র্যান্ডস্ল্যাম জেতেনি। বয়স বেড়েছে, হেয়ারব্যান্ডের নিচে কপালে ভাঁজ। উল্টোদিকে মায়োর্কার তেজি ষাঁড় নাদাল। উইম্বলেডন সেমিফাইনালে সেই ২০০৮ এর পর আবার দু’জনে দেখা হল।

ম্যাচও শুরু হল একেবারে সেয়ানে সেয়ানে। প্রথম সেটই টাইব্রেকারে, ৭-৫ জিতলেও সেকেন্ড সেটে নাদাল ৬-১ এ উড়িয়ে দিল কার্যত। যে সিঙ্গল হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ড ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে গেছে, সেটাকেই নিজের স্ট্রং ফোরহ্যান্ডে রিটার্ন পাঠাচ্ছে নাদাল। ক্রসকোর্ট থেকে দূরূহ সব ভলি মারছে, যেটা দেখে ফেড নিজেও খানিক ব্যাকফুটে।

থার্ড সেটের শুরুতে গেম পয়েন্ট ১-০ হলেও, খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো সেকেন্ড গেমে পয়েন্ট ছিনিয়ে নিয়ে গেম পয়েন্ট ডিফারেন্স ২-১ করে নিল নাদাল। একটা হাফভলিকে রিটার্নে নেটে মারার পর ক্যামেরা তাক করা হল গ্যালারির দিকেম স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছে, ফেডের বাবা নিরাশ। সানগ্লাসে ঢাকা পড়ছে অসহায়তা।

তোয়ালে দিয়ে মুছে গেম শুরু হল। আর শুরুতেই নাদালের ডাবল ফল্ট। ০-১৫। একটা হাফভলি‌, ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন পাঠাতে পারল না নাদাল। ০-৩০। সার্ভিসের রিটার্নে এস মেরে গেম পয়েন্ট ফেডের হাতের মুঠোয়। ০-৪০। গেম ঘুরে গেল। পরের সেট ৩-৬ তে খেলে ম্যাচ বার করে সেট পয়েন্টে ফেড ২-১ এ এগিয়ে।

নাদাল উত্তেজিত। আহত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেন্টার কোর্টে। সবুজ ঘাসে স্নিকার্স ঘষে ফের একপ্রস্থ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। শেষ সেট জিতলেই ম্যাচ ফেডের, আর সেখানেই বারবার হামলা করে চলেছে নাদাল। পরপর পাঁচবার ডিউস হল, ৪-৫ এ গেম হল ফেডেরারের। যেন অসম লড়াইয়ে শিকার ছিনিয়ে নিতে না পারার ক্রোধে ফুঁসছে শক্তিশালী গোখরো।

অপরদিকে তুলনায় অনেকটাই শান্ত ফেড। যে কিছুক্ষণ আগেই রাকেটের ফেসটা ওপেন করে সিঙ্গল হ্যান্ডে ব্যাকহ্যান্ড মেরে গেম নিজের পকেটে পুরেছে। ফার্স্ট সার্ভ ফল্ট, সেকেন্ড সার্ভে ফোরহ্যান্ডে নাদালের রিটার্নকে ফেডেরার ডাউন দ্য লাইন হাফভলিতে বেসলাইন পার করে দিলেন। ম্যাচ ফেডেরারের, যেখানে আসলে ম্যাচ ফেভারিট হিসেবে সেন্টার কোর্টে নেমেছিলেন নাদাল!

৩.

২০০৪-২০০৮। বেসলাইন থেকে অ্যালে, সেন্টার কোর্ট থেকে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন থেকে এটিপি— ডমিনেন্স আসলে কাকে বলে তার সার্থক উদাহরণ রেখে গেছিলেন ফেডেরার। যখন আগাসি, সাম্প্রাস সদ্য বিদায় নিচ্ছেন, তার জায়গায় নতুন মুখ হিসেবে উঠে আসছেন নাদাল-জকোভিচের মতো প্রমিসিং তরুণ, তারই মধ্যে বাসেলের বিস্ময় ফেডেরার তৈরি করে নিয়েছেন নিজের আলাদা জায়গা।

নিজের চারপাশে একটা সোনাঝরা মেহফিল বানিয়ে সেখানকার বেতাজ বাদশা হিসেবে রাজ করছেন একা ফেডেরার। এক একটা ব্যাকহ্যান্ডকে মনে হচ্ছে ইমনের শেষ তারানা ধরেছেন স্বয়ং বিলায়েত খাঁ সাহেব। কিংবা গভীর রাতে একটু মিঠে গলায় মেহেদী হাসান গাইছেন – কিস কিস কো বাতায়ে, জুদাই কা সাভাভ হাম, তু মুঝসে খাফা তো জামানে কে লিয়া আ, রনজি সি সহি…”

উইম্বলেডন সেন্টার কোর্টে ঢুকতেই উপরে তাকালে চোখে পড়বে, রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের লেখা ‘ইফ’ কবিতার দুটো লাইন।

‘If you can meet with Triumph and Disaster

And treat those two impostors just the same.’

সেই প্রথম চোখে দেখা লোকটাকে। বাসেল থেকে উঠে আসা এক তরুণ যে তাঁর উনিশ বছর বয়সে পিট সাম্প্রাসকে সিংহাসনচ্যুত করতে বাধ্য করেছিল। আসলে সবকিছুতে পরিশ্রমই শেষ কথা নয়। নাহলে শচীন, ফেদেরার, মেসি – এদের গল্প পৃথিবীতে এমনভাবে লেখা হত না। যেমন এই ৩৭ বছর বয়সে গোটা টিমের ভার একার কাঁধে তুলে মাঠ জুড়ে ঘুরে বেড়ায় মদ্রিচ‌।

এই লোকগুলো প্রতিটা সার্কিটে নিরুপায়, হতোদ্যম মানুষদের নিভৃতে কবিতা শোনায়। কুঞ্জে মুকুল ধরার সময় যেমন কোনও লুকিয়ে থাকা পাখি সুরে গেয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ঘুমের আবেশ চলে আসে। সারাদিনের ব্যস্ততার পর বাড়ি ফিরে কলতলায় স্নান। মায়ের আদর। ‘আরেকটু খেয়ে নে’ বলে বেড়ে দেওয়া ভাত। আহা, খুব বলতে ইচ্ছে করে, এমন জিনিস, শেষ যেন না হয় হে শ্যামনাথ।

শেষ হয়। একটা সময় তো থামতেই হবে। যখন জানলায় এসে বসবে সেই আশ্চর্য পাখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link