সাকিব আল হাসান ক’দিন ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগের সংবাদ সম্মেলনে বললেন, বাংলাদেশ যদি ভারতকে হারায় তবে সেটা হবে আপসেট। অনেকেই তাঁর এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট ছিলেন না। অনেকের মতেই – আপসেট আবার কি। খেলায় একদল হারবে, একদল জিতবে এটাই নিয়ম।
এই যে কাগজে কলমে নামে ভারি খেলোয়াড়-সহ দলগুলো,যাদেরকে আমরা বড় দল হিসেবে বলি, সেসব দলের বিপক্ষে যখন আইসিসির এসোসিয়েট দল বা সহযোগী দেশসমূহ ম্যাচ খেলে এবং জয় লাভ লাভ করে সেগুলোকে আপসেটই বলা যায়।
তবে বাংলাদেশ ভারতকে হারালে আসলেও সেটা আপসেট হত কি না বা হয় কি না সেটা তর্ক সাপেক্ষই রয়ে যায়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেই ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়ার পর থেকে এমন অনেক আপসেট এর সাক্ষী হয়েছে।আজ তন্মধ্যে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ম্যাচ নিয়ে স্মৃতিচারণ করছে খেলা ৭১।
- বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ( বিশ্বকাপ -২০০৭)
এখনকার বাংলাদেশ কোনো দলকে হারালে সেটা আপসেট কিনা সেই উত্তর আপনাদের কাছে রইল।কিন্তু এই ২০০৭ সালে, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট এর যখন অ,আ,ক,খ শিখছে বাংলাদেশ ও। তখনই বিশ্বকাপে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কে হারিয়ে দিল! ভাবা যায়!
বিশেষ করে, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজই তাদের আগের ম্যাচে দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে তুমুল লড়াই করে,ক্রিস গেইল করেন মারকাটারি সেঞ্চুরি। অথচ তখনকার পুচকে বাংলাদেশ,আশরাফুল আফতাবের নৈপুণ্যে, হারিয়ে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ কে। এটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম আপসেট বলেই ধরা হয়।
- জিম্বাবুয়ে বনাম অস্ট্রেলিয়া (২০০৭ বিশ্বকাপ)
বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ কে হারানোয় ২০০৭ বিশ্বকাপের একমাত্র আপসেট ছিল না সে বছর। মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া, যাদের কে কিনা ভাবা হত ইনভিন্সিবল! সেই হেইডেন, গিলক্রিস্ট, পন্টিং, লি,ম্যাকগ্রা দের অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় তখনকার পুচকে জিম্বাবুয়ে।
- ইংল্যান্ড বনাম নেদারল্যান্ডস (২০০৯ বিশ্বকাপ,ইংল্যান্ড)
স্বাগতিক দেশ ইংল্যান্ড, সাথে খেলা তারই ইউরোপীয় প্রতিবেশী, এসোসিয়েট দল নেদারল্যান্ডস। স্বাভাবিকভাবেই লুক রাইট,রবি বোপারা, ব্রড এনডারসন রাই ফেভারিট ছিলেন সেই ম্যাচে।কিন্তু স্টুয়ার্ট ব্রড যেন ভুলেই যেতে চাইবেন তার করা সেই লাস্ট ওভারের বোলিংটা।
হাত ছোঁয়া দূরত্বে থেকেও একের অধিক বার স্টাম্প ভাঙতে পারেন নি তিনি। ফলাফল স্বরুপ, স্বাগতিক হয়েও গ্রুপের প্রথম ম্যাচ হেরে, প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়ের শঙ্কায় পড়ে ইংলিশরা।
- বাংলাদেশ বনাম আয়ারল্যান্ড (২০০৯ বিশ্বকাপ,ইংল্যান্ড)
সে বিশ্বকাপ বাংলাদেশের জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুলে যেতেই চাইবে,ভারত ও আয়ারল্যান্ডের সাথে একই গ্রুপে পড়ে বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ এবং ভারত এই গ্রুপের ফেভারিট ছিল,কিন্তু বাংলাদেশ তৎকালীন এসোসিয়েট দল আয়ারল্যান্ড এর কাছে হেরে টুর্নামেন্ট এর প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়ে নেয়।
- বাংলাদেশ বনাম হংকং (২০১৪ বিশ্বকাপ, বাংলাদেশ)
২০০৯ এর আয়ারল্যান্ড এর সেই দু:স্মৃতি ভুলতে চাইলেও, ২০১৪ এর কথা ভোলা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। একে সেবারের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দল বাংলাদেশ। তার ওপর খেলা হংকং এর সাথে যাদের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই পেশাদার ক্রিকেটার নন।
সেই দলের সাথে কি না বাংলাদেশ নিজেদের মাঠে ১০৮ রানে অল আউট হয়ে যায়! যদিও দারুণ শুরুর পর এভাবে ইনিংস শেষ হওয়ার মূল দায় দিতেই হবে তখনকার বাংলাদেশের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান দের। ১০৯ রানের টার্গেটে চট্টগ্রামের হাজার হাজার দর্শক এর সামনে ম্যাচ সেদিন জিতে নেয় হংকং।
- আফগানিস্থান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০১৬ বিশ্বকাপ, ভারত)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলেও তারাও আপসেটের শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালে মোহাম্মদ নবী,শেহজাদ রশীদ খান রা,টি-টোয়েন্টর ফেরিওয়ালা খ্যাত ক্রিস গেইল,ব্রাভো,স্যামুয়েলস,সামি দের হারিয়ে দেন।এ ম্যাচটি অবশ্য দর্শক রা মনে রাখবেন আফগানিস্তানের মোহাম্মদ শেহজাদ এর সঙ্গে ক্রিস গেইল এর ম্যাচ শেষে সেই গ্যাংনাম স্টাইল এর নাচের জন্য।
এছাড়া আরও অনেক ম্যাচই উল্লেখ করা যায় যেগুলো আপসেট বলে ধরা যায়,২০১৪ বিশ্বকাপে, আয়ারল্যান্ডের কাছে ইংল্যান্ডের হার, ২০২১ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের কাছে বাংলাদেশের হার। তাছাড়া এ বছরে বিশ্বকাপে এখন অব্দি, নামিবিয়ার কাছে শ্রীলঙ্কার, জিম্বাবুয়ের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ,আয়ারল্যান্ডের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড এর কাছে ইংল্যান্ডের হার উল্লেখযোগ্য।
নামিবিয়া বনাম শ্রীলঙ্কা (২০২২)
মাত্রই এশিয়া কাপ জিতে বিশ্বকাপে খেলতে নেমেছিল শ্রীলঙ্কা। কেন তাঁদের গ্রুপ পর্ব খেলতে হচ্ছে – সে নিয়েই বরং আলোচনা হচ্ছিল বেশি। কিন্তু, সকল আলোচনা থামিয়ে দিল পুঁচকে দল নামিবিয়া।
এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে ৫৫ রানে হারিয়ে দিল আইসিসির সহযোগী দেশ নামিবিয়া। বিশ্বকাপের প্রথম দিনই প্রমাণ হল – ক্রিকেট কেন গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা।
- নেদারল্যান্ডস বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা (২০২২)
জিতলেই সেমিফাইনাল। এমন একটা সমীকরণে মাঠে নেমেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রতিপক্ষও তুলনামূলক সহজ – নেদারল্যান্ডস। কে জানত, সেই ম্যাচেই লুকিয়ে থাকবে বিশ্বকারে সবচেয়ে বড় বিস্ময়।
অথচ, অপ্রত্যাশিত, অভাবনীয় এক ঘটনার দেখা মিলল অ্যাডিলেড ওভালে। দক্ষিণ আফ্রিকা উড়ে গেল নেদারল্যান্ডসের সামনে। বাদ পড়ল সেমিফাইনালের আগেই। ১৩ রানের হারে আবারও আরেকটা বিশ্বকাপ থেকে স্বপ্নভঙ্গ হয় আফ্রিকানদের।
আসলে পরিশেষে বলা যায়, এসব আপসেট দিন শেষে ক্রিকেটের জন্যই ভাল। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের জন্য ভাল।একটা ছোট দল,যখন বড় দলকে হারায় সেটা ক্রিকেটের সেই চিরায়ত প্রবাদ কেই মনে করিয়ে দেয় যে ক্রিকেট ইজ আ গেইম অফ গ্লোরিয়াস আনসারটেইনটি!’