ওটা ক্রিকেট, এটা জীবন!

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতটা উপরে ওঠানো। এক হাতের একটা আঙুলও আকাশের দিকে তাক করা। ডানদিকে তামিম ইকবাল, বাঁয়ে আছেন সাকিব আল হাসান। একটু তফাতে মাশরাফি বিন মুর্তজা গান গাইছেন, ‘বাবা কতদিন কতদিন দেখিনা তোমায়…’

মাশরাফির লম্বা গড়নে মুশফিককে খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয়। তবে তামিমের কাঁধ অনুসরণ করে হাতটা যে মুশফিকের কাঁধে তা বুঝতে কষ্ট হয়না একটুও। মাশরাফি গেয়ে চলেছেন তখনও, সাথে গলা মেলাতে চাচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচাইতে আইকনিক চরিত্রেরা।

গানটার লিরিক্স মনে হয় পুরোটা জানা ছিল না সাকিবের, খুব সম্ভবত বাকিদেরও। সাকিব হঠাৎ বলে বসলেন, ‘এমন একটা গান ধরেন যেটা আমরা সবাই গাইতে পারি।’

মাশরাফিও কম যান না কিন্তু। সাকিবের কথা মাটিতে পড়েনি, মাশরাফি কাঁধটা নিচু করে এক হাতে মাইক্রোফোন ধরে গাওয়া শুরু করেছেন, ‘বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা..’

সাকিব আল হাসান হঠাৎ নেচে উঠলেন। এমনিতে তাঁর চুল কখানা পেছন দিক থেকে কোঁকড়া হয়ে আছে, দেখলে অনেকটা আমেরিকান সাহিত্যিক রবার্ট আর্থারের জনপ্রিয় চরিত্র জুপিটার জোন্সের কথা মনে করিয়ে দেয়। জুপিটার জোন্স এর সাথে সাকিব আল হাসানের সাদৃশ্য অবশ্য আরও আছে। জুপিটারের মত সাকিবও বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচাইতে গম্ভীর চরিত্র, ব্যক্তিত্বের অনুষঙ্গ।

মূল আলোচনায় ফিরে আসি। মাশরাফি গান ধরলেন, সাকিবেরও যেন সারা শরীরে বিদ্যুৎ চমকের মত কি হয়ে গেল। তিনি নেচে উঠলেন, পেছনের চুলগুলো বাতাসে দোলা দিচ্ছিল, খানিকটা ঝুঁকে এসে ছোট ছোট লাফে হাততালি দিচ্ছিলেন গানের তালে, সাকিব আল হাসান নাচছিলেন!

মানে, সাকিব আল হাসানও নাচেন? বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচাইতে রুড, গম্ভীর চরিত্রটাও এভাবে নাচতে পারেন!

আসলে এটাই তো জীবন। ক্রিকেটারদের আমরা দেখি খেলার মাঠে, সেই খেলার মাঠে আমরা ক্রিকেটারদের স্রেফ খেলার সত্তাটাকে দেখি। সেই সত্তাটা হয়তো তাঁদের পুরো জীবনের মাত্র সিকিভাগও। এর বাইরেও ক্রিকেটারদের আলাদা জীবন আছে, সেই জীবনে মাঠের পেশাদারিত্ব নেই, নেই ‘টার্মস এন্ড কন্ডিশন্স’।

একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তখন দেরাদুনে । সাকিব তখন এখনকার মত ‘ঝাঁকড়া চুলের কিশোর’ নন। বাংলাদেশ দল খেলতে গেছে আফগানিস্তানের সাথে। এর আগে নিদাহাস ট্রফিতে চোখ ধাঁধানো পারফর্ম্যান্সের জন্যে সবাই দলের কাছে একটা আলাদা চাহিদা জানিয়ে রেখেছিল। সেই চাহিদার গ্যাস বেলুন চুপসে গেল আফগানিস্তানের সাথে প্রস্তুতি ম্যাচ হেরেই।

এর মধ্যেই ড্রেসিং রুমে দেখা গেল অন্যরকম এক দৃশ্য। দেশে তখন ট্রেন্ডি গানের তালিকাতে আছে ‘অপরাধী’র নাম। সোজা সুরের সরল লিরিক্সের এই গান তখন মানুষের মুখে মুখেই ঘুরছে। এর মধ্যে ড্রেসিং রুমে দেখা গেল, বাংলাদেশ দলও গাইছে ‘অপরাধী’। টেবিলের দুই পাশে পা দিয়ে বসে খোদ অধিনায়ক সাকিব সেই গানে তাল দিচ্ছেন, নাজমুল হোসেন অপু সেই তালে কোমর দোলাচ্ছেন, আরিফুল তো যাকে বলে ‘হাই’ হয়ে গেছেন!

যে গান সাধারণ সব মানুষকে ট্রেন্ডি বানিয়েছে, তাতেই গা ভাসিয়েছেন ক্রিকেটাররাও, কারণ তাঁরাও মানুষ! ক্রিকেটের বাইরেও তাঁদের একটা জীবন আছে। সেই জীবনে যে ভুল আছে তার উদাহরণ আমরা সাব্বির, সৈকতদের থেকে দেখেছি। সেই জীবন যে মহিমান্বিত হতে পারে তা আমরা মাশরাফির থেকে দেখেছি। সেই জীবনে যে প্রেম থাকতে পারে তা আমরা সাকিব তামিম থেকে দেখেছি। আর সেই জীবনে যে বন্ধুত্ব থাকতে পারে তা তো আমরা কালই দেখলাম।

আবার দেখুন, কাল যখন দেশের ক্রিকেটের সবচাইতে আইকনিক পাঁচ চরিত্র গান গেয়ে নাচছেন, হঠাৎ মঞ্চে উঠে গেল মেহেদী হাসান মিরাজ। পেছনে লাথি দিয়ে তাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিলেন মাশরাফি। আপনি এই দৃশ্যে কি দেখেন আমি জানিনা, তবে আমি দৃশ্যে দেখি একটা পরিবার। বড় সদস্য ছোট সদস্যকে পা তুলে নামিয়ে দিচ্ছেন আদর করে। এখানে তাঁরা টিমমেটের ছোট বড় সদস্য না, এখানে তাঁরা ছোট বড় ভাই!

সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মুশফিক, রিয়াদ একসঙ্গে খেলছেন অনেক দিন ধরে। খেলার মাঠের বাইরেও তাই তাঁরা টিমমেটের চাইতে বেশি কিছু। সেটাই আসলে কাল দেখা গেল। ঐ যে বললাম, ক্রিকেটাররাও তো মানুষ। মাঠে আমরা ক্রিকেটার দেখি, মানুষ দেখিনা। মাঠে সাকিব ভাবগম্ভীর ভাবে মিরাজকে পরামর্শ দেন, এখানে খুনশুটি করে নামিয়ে দেন।

ওটা ক্রিকেট, এটা জীবন!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link