আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়: ৭-১ সমীকরণ

এমন হাইপ আর্জেন্টিনার পক্ষে শেষ দেখা গিয়েছিল ২০০২ সালে।

অপরাজিত দল, খেলোয়াড়দের দূর্দান্ত ফর্ম, গণকদের ভবিষ্যদ্বানী; সব ছিল সেবার আর্জেন্টিনার পক্ষে। আর সকলকে ঢাহা মিথ্যে প্রমাণ করে আর্জেন্টিনা প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছিল। এবার ফল শেষ অবধি কী হবে, তা সময় বলবে, কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর আগেই লোকজন লিওনেল মেসির হাতে ট্রফি দেখতে পাচ্ছেন।

আমি একটু বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে, এবার আর্জেন্টিনাকে নিয়ে কেনো এমন হাইপ তৈরি হয়েছে। যারা বিশ্বাস করেন যে, আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ জিতবেই, তারা অন্তত ৭টি পয়েন্টকে সামনে নিয়ে আসছেন। সেই ৭ টি পয়েন্ট একটু দেখব আমরা। আর দেখব একটি সেটব্যাক, যা আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপের দৌড়ে বেশ সমস্যায় ফেলে দিয়েছে ইতিমধ্যে।

জয়ের ৭ সম্ভাব্য কারণ –

১. লিওনেল স্ক্যালোনি

১৯৯০ সাল থেকে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল একজন মানানসই কোচ পাওয়া। যিনি দলটাকে নিয়ে একটা ইউনিট বানাতে পারবেন। বেশিরভাগ সময়ই তারা এমন কোচ পায়নি। কখনও খ্যাপাটে ম্যারাডোনা, কখনও মার্সেলো বিয়েলসার মত দিকহীন মানুষ এবং কখনও হোর্হে সাম্পাওলির মত আত্মবিশ্বাসহীন কোচ ডুবিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে।

২০১৪ সালে ব্যতিক্রম হয়ে এসেছিলেন আলেহান্দ্রো সাবেইয়া। তিনি দলকে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সাবেইয়া এরপর দল, পরে পৃথিবীই ছেড়ে গিয়েছেন। ফলে আর্জেন্টিনার কোচ শূন্যতা পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছিল না।

অবশেষে তাঁরা লিওনেল স্ক্যালোনির মধ্যে সেই ত্রাতাকে খুঁজে পেল। একেবারে লো প্রোফাইল এই মানুষটি হাই প্রোফাইল একটা দলকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে পেরেছেন। তিনি সবচেয়ে বড় যে কাজটা করেছেন তা হল, আর্জেন্টিনা দলকে মেসি-নির্ভরতা থেকে বের করে এনেছেন। মেসি এই দলের এখন মুকুট। কিন্তু তার খারাপ দিনটাতেও দল নিজের মত খেলতে পারে।

মেসি আক্রমণে না থাকলে ডি মারিয়া, লাউতোরো মার্টিনেজ, আলেহান্দ্রো গোমেজ, নিকোলাস গঞ্জালেসরা দিব্যি প্রতিপক্ষকে কাঁপিয়ে দিতে পারেন। মিড ফিল্ডে মেসির অনুপস্থিতিতেও জাদু দেখাতে পারেন এক ঝাঁক তরুণ মিডফিল্ডার। এই দলটিকে একটা ইউনিট হিসেবে লক্ষের আড়ালে জিততে শিখিয়েছেন স্ক্যালোনি। এবার বিশ্বকাপ জিততে হলে এই লোকটিই আর্জেন্টিনার সেরা ভরসা।

২. অন্য মেসি

মেসি ২০০৬ সাল থেকেই দলের সাথে আছেন। কিন্তু এখনও বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দলের প্রধান সমস্যা ছিলো, দলটা মেসির কাঁধে চেপে বসেছিলো। ফলে এই বিশ্বসেরা ফুটবলার কখনোই আর্জেন্টিনার হয়ে সেরাটা খেলতে পারছিলেন না।

এখন স্ক্যালোনির আমলে মেসি এই দলটার একজন হয়ে উঠেছেন। তাকে এই দলটা প্রয়োজন হলে বহন করতে পারে। আর এতেই তার ভেতর থেকে খাটি লিডারশিপ ও পারফরম্যান্স বেরিয়ে আসছে।

মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে আছেন। আর নেতা হিসেবে এখন তার অবস্থান আলোচনার উর্ধ্বে। যে কারণে মার্টিনেজ পরিষ্কার বলেন যে, মেসির জন্য তারা যুদ্ধে যেতেও প্রস্তুত। এই দলটাই বলা চলে মেসির নিজেকে দেখানোর সেরা সুযোগ।

৩. ইএ স্পোর্টসের ভবিষ্যদ্বানী

এটা যদিও খুব ফুটবলীয় ব্যাপার নয়। তারপরও ইতিহাসের কারণে ইএ স্পোর্টসের এই ভবিষ্যতবাণীর ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।

ফিফা সিরিজের গেমের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, বিশ্বখ্যাত গেম নির্মাতা ইএ স্পোর্টস প্রতি বিশ্বকাপের আগে স্টিমুলেশন ব্যবহার করে বিশ্বকাপের জয়ীকে প্রেডিক্ট করে। ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাদেরভবিষ্যতবাণী ভুল হয়নি। আর এবার তাদের বাজির ঘোড়া আর্জেন্টিনা।

ইএ স্পোর্টস বলছে, ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতবে আর্জেন্টিনা। আর টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতা হচ্ছেন মেসি। ২০১০ সালে স্পেন, ২০১৪ সালে জার্মানি ও ২০১৮ সালে ফ্রান্সের ব্যাপারে ভবিষ্যতবাণী করা প্রতিষ্ঠানটিকে একেবারে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না।

৪. জয়ের ধারা

আর্জেন্টিনার আত্মবিশ্বাসের এবার সবচেয়ে বড় কারণ, তাদের জয়ের ধারা। ২০১৯ সালে ব্রাজিলের বিপক্ষে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। এরপর গত প্রায় ৩ বছরে এই দলটি ৩৫টি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলেছে। বিশ্বের কোনো দল এই সময়ে আর আর্জেন্টিনাকে হারাতে পারেনি।

এই সময়ে আর্জেন্টিনা খোদ ব্রাজিলকে হারিয়ে মারাকানায় কোপা আমেরিকা জিতেছে। এই সময়ে ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে উড়িয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনা ফিনালেসিমায়। ফলে এই আর্জেন্টিনাকে হারানোটাই এখন একটা ঘটনা হয়ে উঠেছে। তারা আশা করছে আরও কয়েকটা ম্যাচ অন্তত এই ধারাটা ধরে রাখা যাক।

৫. এমি মার্টিনেজ

সার্জিও গয়কোচিয়া আসলে কিংবদন্তী বা মিথ। অতো বড় গোলরক্ষক ছিলেন না তিনি। ঘটনাচক্র তাকে হিরো বানিয়ে দিয়েছিল। এ ছাড়া আর্জেন্টিনার ইতিহাস ঘুটলে আপনি উবালদো ফিলোল ছাড়া আর বিশ্বসেরা গোলরক্ষক কাউকে এখানে খুঁজে পাবেন না। অথচ এবার আর্জেন্টিনা দলের মেরুদণ্ড নাকি একজন গোলরক্ষক।

হ্যাঁ, এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।

এমি নিজে ঘটনাচক্রে ১ নম্বর গোলরক্ষক হয়েছেন। আর সেই দায়িত্বটা পেয়ে আর্জেন্টিনার গোলপোস্টকে অভেদ্য এক দেয়াল বানিয়ে ফেলেছেন। তারই বীরত্বে আর্জেন্টিনা কোপা জিতেছে বলে মনে করা যায়। এ ছাড়া ইউরোপেও দারুন সময় কাটাচ্ছেন। সব মিলিয়ে আর্জেন্টিনার এবারের বড় ভরসা এমি মার্টিনেজ।

৬. ডিফেন্স

আর্জেন্টিনার ডিফেন্স চিরকালই হাসি তামাশার একটা বিষয় ছিল। ২০১৪ সালে সেটাকে মেরামত করেছিলেন সাবেইয়া। কিন্তু স্ক্যালোনি সেই ডিফেন্সকে শক্তিতে পরিণত করেছেন।
ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো এবং নিকোলাস ওটামেন্ডি মিলে আর্জেন্টিনার ডিফেন্সকে আক্ষরিক অর্থেই দূর্গে পরিণত করেছেন। এই জুটি যেভাবে আর্জেন্টিনার ডিফেন্স সামলাচ্ছেন, তা রূপকথার মত। তাদের দারুন স্বাধীনতাও দিয়েছেন স্ক্যালোনি।

এর সাথে আরও কয়েক জন তরুন ডিফেন্ডারকে। এদের নিয়ে গড়া রক্ষন ভাগ হয়ে উঠতে পারে এবার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সেরা চমক।

৭. ট্রিবিউট টু ম্যারাডোনা

ম্যারাডোনা ছাড়া বিশ্বকাপ?

১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ খেলতে খেলতেই নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। তার আগে তিনটি আসর খেলোয়াড় হিসেবে মাতিয়েছেন। ২০১০ সালে ছিলেন ডাগ আউটে। এর মাঝে বিশ্বকাপগুলোতে অন্তত আর্জেন্টিনার ম্যাচে গ্যালারির নিয়মিত মুখ ছিলেন।

নেচে গেয়ে, চিৎকার করে মাঠ মাতিয়ে রাখতেন। আর্জেন্টিনা নম্বর ওয়ানকে ছাড়া এবার প্রথম বিশ্বকাপ। আর্জেন্টিনার হয়ে শেষ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন তিনি। আরেকবার ট্রফি দেখার জন্য বড় চেষ্টা করেছেন। এবার তাকে ছাড়াই সেই চেষ্টাটা করতে হবে মেসিদের।

মেসিদের পুরো দলের জন্য এটা একটা প্রেরণা। তারা নিশ্চয়ই চাইবেন এই গুরুকে একটা উপহার পৌঁছে দিতে। আর ট্রফির চেয়ে ভাল উপহার আর কী হতে পারে!

সব ভাল ভাল নয়। এর মধ্যে আর্জেন্টিনার একটি মারাত্মক সেট ব্যাক ঘটে গিয়েছে। যেটা বিশ্বকাপ অভিযানেই প্রভাব ফেলার কথা।

১. লো সেলসোর ইনজুরি

গত তিন বছরে আর্জেন্টিনার যে অপ্রতিরোধ্য যাত্রা, এর নেপথ্য নায়ক ছিলেন জিওভান্নি লো সেলসো। মাঝমাঠে তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার এই দলটার জাভি। আর এই সেলসোকেই বিশ্বকাপে পাচ্ছে না আর্জেন্টিনা।

টটেনহাম হটস্পার থেকে ধারে খেলতে গিয়েছিলেন ভিলারিয়ালে। গত ৩০ অক্টোবর তাদের হয়ে খেলতে গিয়েই ইনজুরিতে পড়েন। সেলসো নিজে বিশ্বকাপ খেলার খুব চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন অস্ত্রপচার না করাতে। কিন্তু ডাক্তাররা কথা শোনেননি। অন্য দিকে স্ক্যালোনিও ইনজুরিতে থাকা কাউকে দলে নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে একটা দু:সংবাদ নিয়েই বিশ্বকাপ শুরু করতে হচ্ছে আর্জেন্টিনাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link