ভারতের ‘ভারত’ হওয়ার যাত্রায় শত গলদ

আমাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন একটু পুরনো হয়ে গেলে পারফরফ্যান্সটা ঠিক আগের মতো আর থাকে না। হ্যাং করে, ল্যাগ করে। একটা সময় পছন্দের ফোনটা হয়ে যায় ত্যাক্ত বিরক্তের একটি বস্তু। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে শেষমেশ আমরা ক্ষণিক নতুনত্বের উদ্দেশ্যে ফোন রিস্টার্ট দিই। এরপরে ফোনটা আবার সুন্দরভাবে চলা শুরু করে। কিন্তু সেটা সাময়িক সময়ের জন্যই। কিছুদিন পর ঠিকই পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। এই মুহূর্তের ভারত দলটাকে এই সদৃশতার ঘেরাটোপেই বন্দি করা যায়। 

২০০৮ সাল থেকে চলছে তাদের সর্বোচ্চ ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএল। অনেকে আইপিএলকে বিশ্বের সেরা টি-টোয়েন্টি ফ্রাঞ্চাইজি লিগ বলেও দাবি করেন। অবশ্য সেটা দাবি নয়, একটা প্রমাণিত সত্যই বলা যায়। কিন্তু যে লক্ষ্যে ভারত আইপিএল শুরু করেছিল, তার পুরোটা কি মিটেছে? হয়ত অনেক তরুণ ক্রিকেটার উঠে এসেছে। কিন্তু আরেক দিক দিয়ে হিসেব করলে, প্রাপ্তির জায়গাটা শূন্য। কারণ বছরের পর বছর এমন বৈশ্বিক টি-টোয়েন্টি লিগ খেলেও ভারত এ সময়কালের মাঝে একটিও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। ধোনির হাত ধরে ২০০৭ এ সেই প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা, সেটিই শেষ। 

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, ভারত কি একেবারেই ব্যর্থ একটা দল? সেমিতে বাদ পড়াও কি কোনো দলের জন্য বাজে রেজাল্ট হতে পারে? দেখুন, ভারত যেভাবে টি-টোয়েন্টিতে এগিয়েছে, তাতে তারা সাদা চোখে ব্যর্থ নয়। কিন্তু দলটার নাম যখন ভারত, যাদের পাশে রয়েছে চিরায়ত ফেবারিট তকমা, তখনই প্রশ্ন চলে আসে। আমি, আপনি, যেটাই ধারণা করি না কেন, ভারত এবারের বিশ্বকাপে তাদের পারফরম্যান্স নিয়ে মোটেই খুশি না। কারণ প্রতি আসরেই যে দল শিরোপা উঁচিয়ে ধরার স্বপ্নে বিভোর থাকে তাদের জন্য সেমিতেই আটকে যাওয়া কোনো ভাল ফল নয়। 

এবার আসি এবারে বিশ্বকাপে ভারত কেমন করেছে তা নিয়ে। সুপার-১২ এ সর্বোচ্চ ৪ টি ম্যাচ জিতেছিল ভারত। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সে সব ম্যাচ জয়ের পেছনে দলগত প্রচেষ্টা ছাপিয়ে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আর কিছুটা ভাগ্যের সহায়তায় ভারত ম্যাচ জিতেছে। এখন এটাকে নিয়ে তর্ক হতেই পারে, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে জিতলে সেটা তো দলেরই জয়। কিন্তু টিম ইন্ডিয়া বলতে যেটা বুঝায় সেটার আভাস আসলেই বোঝা যায়নি এবারের আসরে।

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটা বলতে বিরাট কোহলিই জিতিয়েছেন। এখন তাঁর জ্বলে ওঠার দিনে নিশ্চয় অন্য ব্যাটারদের নিষ্প্রভ থাকা ব্যাপারটা আড়ালে যেতে পারে না। আবার বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচেও বৃষ্টির কারণে কিছুটা সহায়তা পেয়েছিল ভারত। কারণ বৃষ্টির পরে আবার যখন খেলা শুরু হয় তখন আউটফিল্ড ভেজা ছিল। আর সেটাতে বলে গ্রিপ করতে সমস্যা হলেও ব্যাটারদের বাউন্ডারি মারতে বেশ বেগ পেতে হয়। যদিও দিনশেষে অমন ম্যাচ হারের দায়টা সাকিব, আফিফদেরই। 

পুরো টুর্নামেন্টে ভারতের সামগ্রিক চিত্রটা দেখলে দেখা যায়,  ম্যাচ জয়ের সংখ্যা বেশি থাকলেও কিন্তু পারফর্মারের সংখ্যা ছিল কম। বল হাতে আর্শ্বদীপ যা একটু করেছেন। আর কেউই তেমন আশা্র প্রদীপ জ্বালাতে পারেননি। স্পিনাররা তো ছিলেন মোটাদাগে ব্যার্থ। লোকেশ রাহুল দুটো ফিফটি পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেটার প্রভাব খুব একটা ছিল না। ভারত মূলত এই টুর্নামেন্ট টা এগিয়েছে বিরাট কোহলি আর সুরিয়া কুমার যাদবের কল্যাণে। এখানে হার্দিক পান্ডিয়ার নামটা যুক্ত হতে পারত।

কিন্তু যে ম্যাচে তিনি পারফর্ম করেছিলেন সে ম্যাচে ভারতের আসলে তেমন কাজে আসেনি। কারণ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারত সেই সেমির ম্যাচটা হেরেছিল ১০ উইকেটে। মোদ্দাকথা, ভারতের বিশ্বকাপ স্বপ্নযাত্রা এগিয়ে যাচ্ছিল এই হাতে গোনা কয়েকজনের হাত ধরে। আর এটা বলাই বাহুল্য, যেকোনো টুর্নামেন্ট জিততে হলে সেই দলকে দল হয়ে খেলতে হয়। ভারত সেটা পারেনি, তাই তাদের শেষটাও হয়েছে বিবর্ণতায়।

শুরুতে আইপিএল নিয়ে বলেছিলাম। হ্যাঁ, এটা ঠিক, অনেক তরুণ ক্রিকেটারই উঠে আসে। এই আইপিএলের বদৌলতে আপনি অনেক আনক্যাপড ক্রিকেটারকেও চিনতে পারেন। কিন্তু সুক্ষ্মভাবে দেখলে, তারা শুধু ঐ উদীয়মান তারকা হয়েই আছে। বৈশ্বিক আসরে তাদের দেখা মেলে খুব কম। ভারতের এই দলটাতেই যেমন দেখা যায়নি তরুণ কোনো ক্রিকেটারকে। জাতীয় দলে পরীক্ষিত পারফর্মাদের নিয়েই দল সাজানো হয়েছে। অথচ তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে দারুণ একটা দল করা যেত এবারেই।

কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল রবিচন্দ্রন আশ্বিনকে, যিনি নিজেই ভারতের টি-টোয়েন্টি দলে নিয়মিত ছিলেন না। অথচ শুধু, অভিজ্ঞতার বুলি আউড়িয়ে যে আশ্বিনকে দলে নেওয়া হল, বড় ম্যাচে তার স্পিন একটুও ধরল না, উইকেটও আসল না। সাইড বেঞ্চে থেকেই পুরো বিশ্বকাপ কাটিয়ে দিলেন যুজবেন্দ্র চাহাল। ভূবির পর ভারতের হয়ে তারই সবচেয়ে বেশি উইকেট। কিন্তু সুযোগ পেলেন না একটি ম্যাচেও। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে লেগ স্পিনাররা দারুণ সুবিধা পায়। কিন্তু চাহালকে স্কোয়াডে রেখে ভারতের ম্যানেজমেন্টের আদৌতে কোনো পরিকল্পনা ছিল কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছেই। থাকলেও সেই পরিকল্পনায় তারা খুব একটা সিরিয়াস ছিলেন না। 

এবার আসি ওপেনিং ব্যাটিংয়ে। খুব সম্ভবত, ভারতের এমন পারফরম্যান্সের কারণ হিসেবে ভারতের ওপেনিং জুটিকেই অনেকে দায়ী করছেন। সেটা যৌক্তিকও বটে। কোনো ম্যাচেই পাওয়ার প্লে দুর্দান্ত কোনো শুরু আসেনি। রোহিত, রাহুল দুজনই স্লো স্টার্ট করেছেন। যেটা দেখে মনে হয়েছিল, দুজনকেই বোধহয় অ্যাংকরিং রোলে ব্যাট করতে পাঠানো হয়েছিল। আর এমন মন্থর গতিতে জুটির কারণে ভারতের ইনিংসও দিনশেষে বড় হয়নি। সুরিয়া, বিরাটের ব্যাটে হয়ত ভারত দিনশেষে হয়ত পার স্কোর পেরিয়েছে। কিন্তু সেটা ঠিক তথাকথিত বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপের মত নয়। 

ভারত খেই হারিয়েছে আরেকটি জায়গাতেও। এবারের স্কোয়াডে ছিলেন না জাদেজা আর বুমরাহ। বুমরাহর অনুপস্থিতিতে বোলিং লাইনআপ কিছুটা তো নাজুক ছিলই। আর জাদেজার অনুপস্থিতিতে যেটা হয়েছে, একজন পরিপূর্ণ অলরাউন্ডারের অভাব বোধ হয়েছে। আর ভারতের ব্যাটিং অর্ডারে তিন ম্যাচে ছিল না কোনো স্পেশালিস্ট বাঁ-হাতি ব্যাটার। অর্থাৎ এক মাত্রিক ব্যাটিং লাইন আপ নিয়েই টুর্নামেন্টে এগিয়েছে ভারত। আর এর ফলে যেটা হয়েছে, প্রতিপক্ষের জন্য পরিকল্পনা করাটাও বেশ সহজ হয়েছিল।  

যা হোক, ভারতের এ দলটা সমস্যা কিংবা গলদ নিয়ে তো অনেক কথা হল। এখন এর সমাধান কই? সমাধানের চেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো, নিজেদের দেশে আইপিএলের মত টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট থাকা স্বত্ত্বেও সেই অর্থে কেউ টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট তৈরি হয়নি। কথাটা অবাক শোনালেও সত্যি। কারণ এক হার্দিক পান্ডিয়া ছাড়া শেষ ৫ বছরে কোন টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট ইয়াংস্টার ভারতের মূল একাদশে এসেছে। অনেকেই সুরিয়া কুমার যাদবের কথা বলতে পারেন। কিন্তু তিনি মোটেই তরুণ ক্রিকেটার নন। আইপিএলই খেলছেন প্রায় একদশক ধরে। অনেক পরে এসেই তিনি জাতীয় দলে ঢুকেছেন। 

মূলত গলদটা এখানেই। আইপিএলে দারুণ পারফর্ম করা ক্রিকেটার যতই লাইম লাইটে আসুক, তিনি শেষ পর্যন্ত বড় কোনো আসরে ভারতের দলে সুযোগ পান না। ভারতের এমন অনেক ক্রিকেটার আছে, যারা নিজেদের পিক টাইমে সুযোগই পাননি শুধুমাত্র দলে প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার থাকার কারণে। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে ভাল করতে হলে নিয়মিত আপনাকে খেলোয়াড় শাফল করতেই হবে। এই যে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হল, এই দলটার এখনকার স্কোয়াড আর ৫ বছর আগের দলটার দিকে একটু নজর দিন।

দেখবেন হাতেগোনা কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই নতুন মুখ। কিন্তু ভারত ৫ বছর আগেও যে ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে খেলতো সেটা প্রায় এখনও একই আছে। অর্থাৎ ভারত দিনশেষে তাদের অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের দিকেই আলোকপাত করে বড় আসরগুলোতে দল সাজায়। কিন্তু টি-টোয়েন্টি হচ্ছে তারুণ্যের খেলা। এখানে সুযোগটা তাদেরই প্রাপ্য বেশি। 

ভারতের ক্রিকেট বোর্ড হয়ত সামনে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বেশ ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়াতেই আছে। তবে ব্যাপারটা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের রিস্টার্টের মত হলেই বিপত্তি। এতে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে হয়ত সাফল্য কিছু মিলবে। কিন্তু আইসিসির টুর্নামেন্ট গেলেই অসংখ্য গলদ বেরিয়ে আসবে। ভারতের এই মুহূর্তে দরকার একটা রিবিল্ড প্রসেস। এর জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে অনেক। এতে সহসাই হয়ত সাফল্য মিলবে না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেই দল ভাল করবেই। এখন দেখার পালা, সেই স্বপ্নযাত্রায় ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী পদচাপ গুলো কেমন হয়। ভারতের জন্য পুরো প্রক্রিয়া রিস্টার্ট নয়, সিস্টেম রিবুট করা বেশি প্রয়োজন।          

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link