দ্য মাশরাফি ইমপ্যাক্ট

আজকের দিনটা সিনিয়রদের ছিলো।

জহুরুল ইসলাম অমি দারুণ ৫১ বলে ৮০ রানের একটা ইনিংস খেললেন। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৯ বলে ৩০ রানের একটা টর্নেডো চালালেন। মুশফিক একটু অখেলোয়াড়োচিত একটা কাণ্ডে আলোচনায় এলেও ব্যাট হাতে ঠিকই ৩০ বলে ৪৩ রানের ইনিংস খেললেন। তবে সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।

ক্যারিয়ারের প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টিতে পাঁচ উইকেট তুলে নিলেন।

মাশরাফির এই পারফরম্যান্সটা কী একটা চপেটাঘাত হয়ে এলো? এই টুর্নামেন্টের আগে তাকে নিয়ে সন্দেহ করাদের একজন আমি ছিলাম। তাই এটাকে একটা জবাব বলে মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। আসলে মাশরাফি আরেকবার দেখিয়ে দিলেন, তাকে নিয়ে শেষ কথা বলার উপায় নেই।

মাশরাফি আর্ন্তজাতিক টি-টোয়েন্টি শেষ খেলেছেন ২০১৭ সালে। শ্রীলঙ্কা সফরে অত্যন্ত রহস্যময় এক পরিস্থিতিতে হঠাৎ অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। অবসর নিয়েছিলেন, নাকি অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছিলো; এ বিতর্কের সম্ভবত শেষ নেই। তবে এটা নিশ্চিত যে, তার আরও দু একটা বছর এই ফরম্যাটকেও কিছু দেওয়ার ছিলো।

তাই বলে এই ২০২০ সালের শেষ মাসে এসেও পাঁচ উইকেট নেবেন মাশরাফি!

এটা আসলে অতিবড় মাশরাফিভক্তের পক্ষেও অনুমান করা কষ্ট ছিলো। পরিস্থিতিটা দেখুন। সর্বশেষ আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলেছেন গত মার্চে; জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ওই মাসেই শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছেন; ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। এরপর গত ১০ মাস কোনো ধরণের খেলার মধ্যে ছিলেন না।

এই সময়টা বেশীরভাগ খেলোয়াড়ই খেলার বাইরে ছিলেন। কিন্তু তারা আবার এক ধরণের ফিটনেস প্রোগ্রামের আওতায় ছিলেন। মাশরাফি চাইলেও তা থাকতে পারেননি।

নিজে করোনায় ভুগেছেন লম্বা সময় ধরে, এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় ছোটাছুটি করতে হয়েছে। সবমিলিয়ে ক্রিকেট তখন তার আশেপাশেও ছিলো না। কিছুদিন আগে যে প্রেসিডেন্টস কাপ হলো, তার প্রস্তুতির সময়ও মাঠে আসতে পারেননি।

এমনকি এই বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপেও তার খেলাটা অনিশ্চিত ছিলো। যখন এই টুর্নামেন্টের জন্য ফিটনেস টেস্ট নেওয়া হচ্ছিলো, তখনও মাশরাফি জানেন না যে, তার শরীরের কী অবস্থা। এর মাঝে মিরপুর সিটি ক্লাব মাঠে একদিন রানিং করতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়েছিলেন। সেই চোটের কী অবস্থা, তা জানার জন্য পরীক্ষাটাও করাতে বের হতে পারছিলেন না। কারণ বাসায় ছেলে আর মেয়ে করোনায় আক্রান্ত ছিলো। ফলে আইসোলেশনে থাকা মাশরাফি ফিটনেস টেস্ট দেওয়া তো দূরে থাক, এক্স রে করাতেও বের হতে পারেননি।

এ অবস্থায় মাশরাফি যে এই টুর্নামেন্ট খেলবেন, সেটা আশা করাই বাড়াবাড়ি ছিলো না?

মাশরাফি এলেন। তাঁকে ‘ফ্রি এজেন্ট’ করে দেওয়া হলো। চারটি দল তাকে নিতে চাইলো। লটারিতে তাকে পেলো জেমকন খুলনা। খুলনার মালিকপক্ষ বললো, তারা মাশরাফিকে পেয়ে খুব খুশী। আমরা অনুমান করলাম, ব্র্যান্ড ভ্যালুর কারণেই মাশরাফিকে নিয়ে এই উচ্ছাসটা ছিলো।

আমি পরিষ্কার বলি, আমি অন্তত কল্পনা করিনি যে, মাশরাফি বোলার হিসেবে কিছু করতে পারবেন। ১০ মাস প্রায় বসে থাকার পর ৪০ ওভার ক্রিকেট খেলাটাই তো বাড়াবাড়ি।

মাশরাফির অভিজ্ঞতার ওপর অবশ্যই ভরসা আছে। কিন্তু সে জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় লাগবে না? সে জন্য অনুশীলন করতে হবে না?

সেগুলো ছিলো না বলেই আমরা ধরে নিলাম, মাশরাফি ব্র্যান্ডিং ছাড়া আর কোনো ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারবেন না। এই ধরে নেওয়ায় ভুল ছিলো না। সাধারণ খেলোয়াড়ের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য এটাই সত্যি। কিন্তু মাশরাফি তো আরেকবার প্রমাণ করতে আসলেন যে, তিনি সাধারণ নন, অতি মানুষ।

প্রথম দুটি ম্যাচে একটি করে উইকেট পেলেন। কৃপণ ছিলেন। আমরা ধরে নিলাম, অভিজ্ঞতার চাতুরী দিয়ে গা বাচিয়ে যেতে যারছেন মাশরাফি। কিন্তু আরেকটু প্রদর্শনী বাকি ছিলো। আর সেটাই আজ মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে দেখালেন মাশরাফি।

৪ ওভারের স্পেলে ৩৫ রান দিয়ে তুলে নিলেন ৫ উইকেট। সেই সাথে ১৫০ টি-টোয়েন্টি উইকেট পার করে ফেললেন। আর সাথে নিজের দল খুলনাকে নিয়ে গেলেন ফাইনালে। বাংলাদেশ স্বাক্ষী হলো আরেকটা মাশরাফি ম্যাজিকের।

হ্যা, আরেকটা ধাপ বাকি আছে।

সেই ধাপটা পার হতে পারলে আরেকটা রূপকথা লেখা হবে। বিপিএলের মঞ্চ মাশরাফির সেই রূপকথা অনেকবার দেখেছে। এবার এই টুর্নামেন্টের রূপকথা দেখার পালা। আর সেটা করতে হলে খুলনার সাকিব আল হাসানদেরও নিশ্চয়ই জ্বলে উঠতে হবে। সাকিবরা নিশ্চয়ই ১৮ তারিখের অপেক্ষায় আছেন।

আমরাও অপেক্ষায় আছি। এই মর্তে অদেখা কতো জাদু মাশরাফি আর দেখাবেন, সেই অপেক্ষায় আছি আমরা।

এটাই মাশরাফির ইমপ্যাক্ট। কে জানে, এই ইমপ্যাক্টের আরো অনেক রং হয়তো এখনো দেখা বাকি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link