‘অজি’ত্বের গর্ব ভেঙেছিল মিরপুরে

দরকার তখন একটা মাত্র উইকেট! এতেই হয়ে যাবে ইতিহাস, অর্জন হবে ঐতিহ্য! যে ঐতিহ্য জাদুর কালিতে বিসিবির হল অফ ফেইমে লেখা থাকবে ততদিন, যতদিন থাকবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অস্তিত্ব!

সাকিব লম্বা স্পেল করে গিয়েছেন, তরুণ মিরাজও ১৯ ওভার করেছেন। ক্যাপ্টেন মুশি তাই বল তুলে দিলেন ‘হিরো বিহাইন্ড দ্যা ওয়াল’ তাইজুল ইসলামের হাতে! এরপর…

জশ হ্যাজলউড ডিফেন্স করতে গেলেন, ব্যাটের ফাঁক দিয়ে বল গিয়ে লাগল প্যাডে। উইকেটের পেছন থেকে স্বভাবসুলভ বাম হাত উরুতে, ডান হাত উঁচিয়ে তুলে আবেদন জানালেন মুশি। মিড অন থেকে আঙ্গুল তুলে দৌড়ে আসছেন নাসির! অত:পর, আম্পায়ার আঙুল তুলে দিলেন।

এরপর যেন রচিত হল ইতিহাস! লেখা হল ঐতিহ্য! সেই ঐতিহ্যের সাক্ষী হতে, ম্যাচের সাক্ষী প্রতিটি উইকেট তুলে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় যেন মেতে উঠলেন খেলোয়াড়েরা! নাক উঁচু অজিদের যে হারানো গিয়েছে! যা অর্জন করতে লেগে গিয়েছে ১৭ টি বছর!

প্রথমে কাজটি এত সহজ ছিল না। ক্রিকেটের প্রতি নিজেদের প্যাশনটা অজিদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবেই চোখে পড়ে। টেস্ট ক্রিকেটের প্রসঙ্গে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় আরো উঁচুতে। একেকটি টেস্ট সিরিজের আগে অস্ট্রেলিয়া যতদিন-ব্যাপী ক্যাম্প করে, ততটা টেস্ট প্লেয়িং আর কোন নেশনসের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশের সাথে টেস্টের প্রস্তুতি নিতে অস্ট্রেলিয়া উড়ে গিয়েছে পশ্চিমে, যেখানে নাকি তাঁরা পেয়েছিল বাংলাদেশের মত পরিবেশ!

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্টের আগে তাই স্বস্তিতে থাকা যাচ্ছিল না। যদিও দেশের মাটিতে টেস্ট জয়ের টোটকা বাংলাদেশ পেয়ে গিয়েছিল আগের বছরের ইংল্যান্ড সিরিজেই! তবু দলটা যখন মার্ক ওয়াহ, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্কের উত্তরসূরি স্টিভ স্মিথ, ওয়ার্নারের অস্ট্রেলিয়া, মনের কোণে সংশয় মিশ্রিত ভয় থেকেই যায়!

তবু ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা! কেননা ক্রিকেট টা শুরুই যে হয় টস দিয়ে! সকালের রোদে ক্রিকেট দেবী মুখ তুলে চাইলেন! মুশি টস জিতে ব্যাটিং নিলেন! এ ধরণের পিচে যেমনটা করতে হয় আরকি! কিন্তু, ক্রিকেট-দেবীর সৌভাগ্যের রেশ থাকল না বেশিক্ষণ! নিজের খেলা অষ্টম বলে প্যাট কামিন্সের বলে ক্যাচ তুলে দিলেন সৌম্য সরকার, পিটার হ্যান্ডসকম্ব যা লুফে নিতে ভুল করেননি!

মিরপুরের গ্যালারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দর্শকদের তখন মাথায় হাত! এরপর তিনে নামা ইমরুল কায়েস ডাক মারলেন, ৪ এ নামা সাব্বির তো নেমেই ফিরে গেলেন প্যাভিলিওনে! প্যাট কামিন্স যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ান অল-এটাক পেস কম্বিনেশনের ওসব পিচ-টিচ লাগে না! রিভার্স সুইং করানো যায় যেকোন জায়গাতেই!

ইমরুল সাব্বির সৌম্য ফিরতে পারেন! তামিম সাকিব হারার আগেই হেরে যাবার পাত্র নয়! তামিম করলেন ৭১, সাকিব করলেন ঠিক ৮৪! বাংলাদেশ পেয়ে যায় এই পিচে লড়াই করার মত স্কোর- ২৬০!

ব্যাটিং এ এরপর অস্ট্রেলিয়া! স্টিভ স্মিথ আর ডেভিড ওয়ার্নার যখন ফতুল্লা ফিরিয়ে আনছিল, ত্রাস হয়ে দেখা দিলেন সাকিব! টপাটপ দুই উইকেটে ম্যাচে তখন ফিরেছে বাংলাদেশ! এরপর মিডল অর্ডারে ম্যাথু ওয়েড আর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ভয় ধরিয়ে দিচ্ছিলেন, তখনও টিম বাংলাদেশের ত্রাতা সাকিব! অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের সংগ্রহ- ২১৭! ৪৩ রানের লিডে তখন প্যাট কামিন্সের ভাবনাটা ঘুরিয়ে দিয়েছে ৩ উইকেট নেওয়া মিরাজও- সাব কন্টিনেন্টের পিচ প্রিয়তমার চেয়েও রহস্যময়ী!

বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস একার্থে ছিল তামিমময়! তামিমের ১৫৫ বলে করা ৭৮ রান ছাড়া বলার মত ব্যাট করেছেন স্রেফ মুশফিকুর রহিম! তবুও নিজের ভুলে ৪১ রানে কাঁটা পড়ে প্যাভিলিওনে ফেরার পর বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় ইনিংসের সংগ্রহ ছিল ২২১ রান!

২৬৫ রানের টার্গেটে তখন ব্যাট করতে নেমেছে অস্ট্রেলিয়া! ডেভিড ওয়ার্নার নাকি উপমহাদেশের পিচে ভাল খেলেন না! মিরপুরের ‘ন্যাওটা’ সকলে তখন এই উক্তিকেই মনেপ্রাণে সত্যি হিসেবে চাইছে। কিন্তু ক্রিকেট-দেবীর মনে ম্যাচ নিয়ে সরল সমীকরণ ছিল না। সাব-কন্টিনেন্টে ডেভিড ওয়ার্নারের রাজসিক প্রত্যাবর্তন তিনি করালেন এমনই এক সময়ে, যখন ওয়ার্নারকে তার দলের বড্ড বেশি দরকার। ততদিনে বধ্যভূমি হয়ে যাওয়া পিচে ওয়ার্নার দেখালেন তিনি কতটা সেরা, করলেন ১১২!

ম্যাচ কি তবে বেরিয়ে যাবে? নাহ, দলে একজন সাকিব ছিলেন! ওয়ার্নারকে এলবিডব্লিউ এর ফাঁদে ফেলে প্যাভিলিওনে ফেরালেন! তিন উইকেটে ১৫৮ থেকে ২৪৪ এ অল-আউট! হাতছোঁয়া দূরত্বে পরাজয় মেনে নিতে হল ফাইটিং অস্ট্রেলিয়ার, যে দূরত্বে থেকে আমরা একই স্বাদ নিয়েছিলাম তার আগের বছর ইংল্যান্ডের সাথে প্রথম টেস্টে! প্রকৃতি যা কেড়ে নেয়, তা বুঝি ফিরিয়েও দেয়!

এরপর ওই উল্লাস, ওই আনন্দ, উইকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি – এত কিছুর মাঝেও সাকিবকে কেউ ভুলে যায় নি। দুই ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে তিনি নিজেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, এত বছর পরও বোলার সাকিব যে এক রহস্য তা বুঝিয়েছেন। হোক এতে পিচের কারিকুরি, কম্পিউটার এনালাইসিসের এই যুগে পুরনো সাকিবও পারে অস্ট্রেলিয়ানদের হাড় কাঁপিয়ে দিতে!

তবুও সাকিবকে যতটা মনে রাখতে হবে, ততটাই রাখতে হবে তামিমকে। তামিমের ইনিংসই যে বাংলাদেশের অক্সিজেন, তামিম জিতলে যে আসলেই জেতে বাংলাদেশ তা এই ম্যাচের স্কোরকার্ডের দিকে লক্ষ করলেই বুঝে ফেলা যায়!

এই ম্যাচে ভোলা যাবে না দুই ইনিংসে মোট ৫ উইকেট নেওয়া মিরাজকে, শেষ ইনিংসে ৩ উইকেট নেওয়া তাইজুলকেও – আর ভোলা যাবে না ডিপ মিড অন, স্লিপ, স্কয়ার লেগ থেকে উইকেট তুলতে ছুঁটে আসা প্রত্যেককেই – যে ছবি বাঁধাই করে রাখা আছে প্রত্যেক ক্রিকেটপ্রেমীর মনে!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link