বিশ্বকাপ খেলে ৩২ টা দেশ। কিন্তু প্রতি আসরের ক্রান্তিলগ্নে মন জয় করে নেয় গুটিকতক দেশ। সেই নগণ্য সংখ্যার ছোট্ট তালিকাটায় এবার যদি একটি দলের নামও করা হয় সেটি হল- মরক্কো। হিমালয় ডিঙানো সাফল্য কিংবা শত মাইলের সমুদ্র স্রোতের প্রতিকূলতা টপকানোকে যদি উপমা অর্থে সফলতার সংজ্ঞা ধরা হয় মরক্কো সেই সংজ্ঞায় এবারের বিশ্বকাপে নবলিখিত একটা মহাকাব্যের নাম। মরক্কোর এ রুপকথাময় যাত্রা নিয়ে কথা বছরের পর বছর গল্প হতে পারে। তাদের ঐতিহাসিক এ যাত্রা হতে পারে অনেক অনুপ্রেরণার স্বপ্রণোদিত উৎসও।
না। মরক্কো বিশ্বকাপ জিতে ফেলেনি। তাদের নামের পাশে বৈশ্বিক কোনো শিরোপাও যোগ হয়নি। কিন্তু মরক্কো যা করে দেখিয়েছে তা এতদিন পর্যন্ত শুধু কল্পলোকে ভাবনা করার মতোই ছিল। আফ্রিকার কোনো দেশ বিশ্বকাপের সেমিতে ওঠেনি। অভাবনীয় সেই সাফল্য এসে ধরা দেয় মরক্কোর মাধ্যমে।
দরিদ্র জর্জর এক দেশ মরক্কো। আফ্রিকার এ দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বাংলাদেশের চেয়ে জিডিপিতে পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। আর সব কিছুতে পিছিয়ে আড়ালে থাকা এমন একটা দেশই এবার নজর কাড়ল। কিভাবে নজর কাড়ল, তাদের অবলম্বন, গর্ব করার মত পু়ঁজি ফুটবল দিয়ে।
মরক্কো বিশ্বকাপের শেষ চারে যাবে- এমন চোখ কপালে ওঠার মত প্রত্যাশা হয়তো আগে কেউই করেনি। কিন্তু সবার ভাবনা, হিসাব নিকাশ পাল্টে দেওয়ার জন্য যে প্রাণ সঞ্চার আর উদ্যমতা প্রয়োজন তা ঠিকই ছিল আশরাফ হাকিমি, হাকিম জিয়েচদের এ দলটায়।
সেই রসদের বলয়েই বিশ্বকাপে এসেছিল মরক্কো। কিন্তু এরপর তারা যা করে দেখাল তা হয়তো তাদের নিজেদের জন্যও স্বপ্নালোকে ভেসে যাওয়ার মত ছিল। শুরুটা হল, বেলজিয়ামকে হারিয়ে বিশ্বকাপে অঘটন ঘটানোর মাধ্যমে। এমন অঘটনে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথটাও খুলে যায় মরক্কোর জন্য। হয়তো ঐ প্রাথমিক সাফল্যের মোহিত হয়ে উঠছিল মরক্কোনরা।
জ্বলে ওঠার আপন শক্তিকে তারা তাক লাগিয়ে দিল পরের রাউন্ডেও। স্পেনকে হারিয়ে উঠে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে। রুপকথার যাত্রা ততক্ষণ পর্যন্ত বলাই যায়। কিন্তু এরপর যা তারা করে দেখাল তাতে আর সেটি শুধু রুপকথাতেই আটকে থাকলো না। নিজেদেরকে যেন আরো জানান দিতে থাকল মরক্কোর এ দলটা। কোয়ার্টার ফাইনালে এসে চমক দেখিয়ে হারিয়ে দিল পর্তুগালকেও। ব্যাস। ওখানেই তৈরি হয়ে গেল একটা ইতিহাস। আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে মরক্কো চলে আসে সেমিতে।
সেমিতে মরক্কোর প্রতিপক্ষ এক সময়কার বন্ধুরাষ্ট্র ফ্রান্স। এই ফ্রান্সেরই এক সময়কার উপনিবেশ ছিল মরক্কো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মরক্কোর ৪০ হাজার সেনাকে ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর হয়ে লড়াইয়ে পাঠিয়েছিল ফ্রান্স। মূলত সেখান থেকেই বিরোধপূর্ণ আবহের সৃষ্টি হয়। মরক্কোনদের ক্ষোভের রোষানলে পড়ে ফ্রান্স। সেই পরিক্রমায় বছর দশক পরে স্বাধীনতা পায় মরক্কো।
পুরনো বিরোধ। সম্ভবত সেই ইতিহাসেই ২০২২ বিশ্বকাপে এসে আবারো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো মরক্কোনরা। মাঠের ফুটবলে মিলল সেই রেশ। মরক্কো যে শুধু রুপকথা বলয়ে বিশ্বকাপের এতদূর পথ পেরিয়ে আসেনি তা আবার প্রমাণিত হল।
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স৷ পুরো আসর জুড়ে ফ্রেঞ্চ রক্ষণভাগে পরীক্ষা বলতে গেলে কোনো দলই নিতে পারেনি। কিন্তু সেমির এ ম্যাচে মরক্কোর আক্রমণ যেন নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে উঠলো ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডারদের। মুহুর্মুহু আক্রমণ। গোলটাই শুধু পায়নি মরক্কোনরা। কিন্তু নিজেদর ফুটবল নান্দনিকতার এক ঝলক ঠিকই দেখিয়ে গেল মরক্কো।
হ্যাঁ। দিনশেষে ম্যাচটা মরক্কোনরাই হেরেছে। তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা সেমিতেই আটকে গেছে ৷ কিন্তু পুরো বিশ্বের কাছেই যেন একটা বার্তা দিয়ে গেল তারা। তারা দেখিয়ে দিয়ে গেল যে, পশ্চিমাদের আগ্রাসনে ধুঁকতে থাকা একটা আফ্রিকান দেশও বিশ্বের মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠতে পারে। হোক সেটি ফুটবল দিয়েই। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের মহিমা তো আর অস্বীকার করা যায় না।
আফ্রিকা কিংবা আরব, দুই বিশ্বের কাছেই মরক্কোর এ সাফল্যযাত্রা দারুণভাবে ছুঁয়েছে। অ্যাটলাস লায়ন্সরা ভাসছে অভিনন্দন জোয়ারে। হবেই বা না কেন! যা আগে কেউ পারেনি, সেই কাজটাই করে দেখাল মরক্কো। আফ্রিকা মহাদেশের হয়ে সবচেয়ে বড় সাফল্যটা এনে দেখাল। আগে যেটা রুপকথা মনে হত, এখন সেটাই বাস্তব চিত্রনাট্যে চিত্রায়িত হল। আরব্য রজনীর বাহকের স্বীকৃতি তো এই অ্যাটলাস লায়ন্সদেরই দেওয়া উচিৎ। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, এই মরক্কো অধ্যায়টা আরব্য রজনীতে অ্যাটলাস লায়ন্স বলে যুক্ত করলেও মন্দ হয় না।