লাঞ্চের খানিকক্ষণ আগেই হঠাত একটা থ্রো এসে পায়ে লাগলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন জাকির হাসান। ড্রেসিং রুম থেকে ফিজিও দৌড়ে আসলেন। আর কী ব্যাট করতে পারবেন জাকির? মিনিট কয়েক বন্ধ রইলো খেলা। এরপরই আবার ঠিকই উঠে দাঁড়ালেন জাকির। ব্যাট হাতে নিলেন। ইনিংস বড় করার অভ্যাস তাঁর।
অভিষেক টেস্ট। ভারতের বোলিং লাইন আপ। ৫১৩ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামা। সবকিছুই ছিল তাঁর বিপক্ষে। তবুও শতরানের কাছাকাছি পৌছে গিয়েছেন তখন। তাঁর নামের পাশে ৮৭ রান। একটু নার্ভাস থাকবেন নিশ্চয়ই। না, জাকিরের ব্যাটে এসবের বালাই নেই। যেই কুলদীপকে খেলতে হিমসিম খাচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাটাররা, তাঁকেই মাথার উপর দিয়ে ছয় মেরে প্রবেশ করলেন নার্ভাস নাইন্টিজে। আর শতরানের মাইলফলকটাও স্পর্শ করলেন বাউন্ডারি মেরে।
একটা টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ দিনের সকাল। মাথার উপর পাহারসম টার্গেট। তারপর আবার এই ম্যাচেই অভিষেক হওয়া একজন ব্যাটারের জন্য এভাবে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করা সহজ না। চট্টগ্রামের উইকেট তাঁকে সাহায্য করছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাট হাতে জাকিরকে ভীষণ সাবলীল মনে হচ্ছিল। পেস, স্পিন দুইটাই দারুণ খেলছেন, দায়িত্ব নিয়ে খেলছেন।
যদিও জাকির টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার পর নানারকম প্রশ্ন উঠেছিল। আসলে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করা ক্রিকেটারদের ওপর বিশ্বাস রাখার সংস্কৃতিটাই তো উঠে যাচ্ছিল। ক্রিকেটারদের মনে গেঁথে গিয়েছিল যে ঘরোয়া ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ফারাক অনেক।
অনেকেই জাতীয় দলে এসে আর প্রমাণ করতে পারেন না বলেই হয়তো। সেজন্যই বিসিএল, এনসিএল রান বন্যায় ভাসিয়ে দেয়ার পরেও জাকির কেন দলে এমন প্রশ্ন জাগে অনেকের মনে। অথচ জাতীয় দলেও আসার আগে সবগুলো পরীক্ষাই তিনি উৎরে এসেছেন।
গতবছর বিসিএলে রান করেছিলেন ৯৯ গড়ে। ঠিকই পড়েছেন। এবারের এনসিএলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। এরপর ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে খেললেন ১৭৩ রানের ইনিংস। এই সবকিছু তো আর মিথ্যা হয়ে যেতে পারেনা। অন্তত ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফর্মারদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য হলেও জাকিরের রান করাটা প্রয়োজন ছিল। লোকাল ক্রিকেটারদের বিশ্বাসটা ফিরে পাওয়ার জন্য হলেও জাকিরের রান করাটা প্রয়োজন ছিল।
তবে লাঞ্চের ঠিক আগে পূজারার থ্রোটা তাঁর হাটুতে লাগার পর মনোযোগে খানিকটা চিড় ধরেছিল। আবার কীভাবে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে হয় সেটাও জাকির খুব ভালো করেই জানেন। লাঞ্চের পর আবার প্রথম থেকেই শুরু করলেন।
তাঁর ওপেনিং পার্টনার নাজমুল হোসেন শান্ত ফিরে গেলেন। এরপর ব্যাট করতে নামা ইয়াসির আলী রাব্বিও তাঁকে সঙ্গ দিতে পারলেন না বেশিক্ষণ। সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা যার ওপর সেই লিটনও ফিরলেন হতাশ করে। একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সতীর্থদের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ দেখছিলেন জাকির।
আরেকপ্রান্তে তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে। ইনিংস বড় করাটাই তাঁর একমাত্র অভ্যাস, একমাত্র লক্ষ্য। এবারের জাতীয় ক্রিকেট লিগেও ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। এরপর ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে ১৭৩ রানের বিশাল ইনিংস। জাকিরের ইনিংস বড় করতে পারার এই ক্ষমতাই তো থাকা জাতীয় দলে নিয়ে এসেছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসেও সেই ধারবাহিকতা ধরে রাখলেন।
অভিষেক টেস্টেই ভারতের বিপক্ষে তুলে নিলেন সেঞ্চুরি। কুলদীপ যাদব, অক্ষর প্যাটেলদের সামলে নাম লেখালেন ইতিহাসের পাতায়। প্যাটেলের বলে সুইপ করে ছুঁয়ে ফেললেন তিন অংকের সেই ম্যাজিকাল ফিগার। এই সেঞ্চুরি জাকিরদের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিল। বিশ্বাস ফিরে পেল ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করতে থাকা আরো অনেক ক্রিকেটারই। এই সেঞ্চুরি জাকিরের, এই সেঞ্চুরি ঘরোয়া ক্রিকেটেরও।