টেস্টে উইকেটরক্ষকদের ব্যাটিংয়ের ধরণটাই বদলে দিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। নিচের দিকে নেমে ম্যাচের চিত্রনাট্য বদলে দেয়া ইনিংসে ম্যাচ জিতিয়েছেন বহুবার। তাঁর অবসরের পর তাই হন্যে আরেকজন উইকেটরক্ষক খুঁজছিল ভারত। সাহার ব্যাটিংটা যে মোটেও ধোনির মানের নয়। অবশেষে ভারত খুঁজে পেয়েছে তাঁর খেয়ালি রাজপুত্রকে, যেকোনো মূহুর্তে ব্যাট হাতে ম্যাচের ফলাফল বদলে দিতে পারা ঋষাভ পান্তকে।
মিরপুরে দলকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানো ৯৩ রানের ইনিংস খেলে ছাড়িয়ে গেলেন ধোনিকেও। এ নিয়ে মাত্র ৫৫ ইনিংসেই ১১ বার নব্বই ছাড়ানো ইনিংস হয়ে গেলো এই তরুণের। অন্যদিকে পুরো ক্যারিয়ারে দশবার নব্বই ছাড়ানো ইনিংস খেলেছেন ধোনি।
কোনো সন্দেহ ছাড়াই ভারতের সেরা টেস্ট উইকেটকিপার ব্যাটার পান্ত। দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মাটিতে সেঞ্চুরি করেছেন। ফর্মের বিচারে তো ভারতের সেরা টেস্ট ব্যাটার তিনিই। উইকেটকিপিংয়ের রোমাঞ্চ বাদ দিয়ে কেবল ব্যাটিং বিবেচনায় নিলে ভারতের ইতিহাসের সেরা উইকেটরক্ষক ঋষাভ পান্ত।
তবে কেবল ভারত নয়, ফর্মটা ধরে রাখতে পারলে আগামী বছর কয়েকের মাঝে সর্বকালের সেরা উইকেটরক্ষক হয়ে উঠার সক্ষমতা আছে তাঁর। ৪৪.৩৫ গড়ে ২২৬২ রান নিয়ে সর্বকালের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক উইকেটকিপারের মাঝে পান্তের অবস্থান ৩০তম।
তিনি কতদিন ফর্ম ধরে রেখে খেলতে পারবেন সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে কমপক্ষে ২০০০ রান করা উইকেটকিপারদের মধ্যে কেবল এবি ডি ভিলিয়ার্স, এন্ডি ফ্লাওয়ার এবং অ্যাডাম গিলক্রিস্টের গড়ই তাঁর চাইতে বেশি।
বাকি কিপারদের মতো পান্ত ব্যাটিং অর্ডারে নিচের দিকে ব্যাটিং করেন না। বরং উপরের দিকে ব্যাট করতেই বেশি স্বছন্দ তিনি। টপ সিক্সে ব্যাট করাদে মাঝে পান্ত নবম সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক, ৪৯ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ১৫৪০ রান। এই পজিশনে কেবল ডি ভিলিয়ার্স, ফ্লাওয়ার, গিলক্রিস্ট এবং লিস অ্যামেস এর চাইতে বেশি গড়ে রান করেছেন।
অন্যদিকে বেশিরভাগ সময় পান্ত ব্যাটিং করেছেন বোলারদের স্বর্গরাজ্যে। বর্তমানে পাকিস্তানের বাইরে ফ্ল্যাট পিচ দেখা একপ্রাক্র অসম্ভব। অনেকসময়ই তাঁকে ব্যাটিং করতে হয়েছে সিনিয়রদের উইকেট পড়ার পর, টেলএন্ডারদের নিয়ে।
দলকে বিপদের হাত রেখে রক্ষা করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মাঝেমধ্যে দেখা যায় টপ অর্ডারকে ধবসিয়ে দিয়ে রিদমে থাকা বোলারকে একা হাতে সামলাতে হয় পান্তের। সেই কাজটা দারুণভাবেই করে আসছেন তিনি। এইকারণেই পূর্বের উইকেটকিপার ব্যাটারদের সাথে পান্তকে তুলনা করা কঠিন।
২০২১ সালের পর থেকে ১০০ রানের আগেই ২ বা দুই এর বেশি উইকেট হারিয়ে ফেলা অবস্থায় চাপের মুখে ব্যাটিংয়ে নামতে হয়েছে পান্থকে। এই সময়টাতে তিনি ৬১ গড়ে ৭৩৩ রান করেছেন। অন্য কোনো ব্যাটার রান কিংবা গড় কোনোটাতেই তাঁর ধারেকাছে আসতে পারেননি। দলের মোট রানের ৩০ শতাংশ রান তিনি একাই করেছেন বিপদের মূহুর্তে।
কেবল রান কিংবা গড় নয়, আক্রমণাত্নক ব্যাটিং করে উল্টো বোলারকেই চাপের মুখে ফেলেছেন পান্ত। তাঁর ৮৪ স্ট্রাইকরেট ছাপিয়ে যেতে পারেননি কেউই। প্রতিপক্ষ বোলার যতই ভালো হন কিংবা ফিল্ডিং যতই আটোসাটো হোক না কেন, পান্তের ব্যাটিংয়ে তাঁর প্রভাব পড়েনি বিন্দুমাত্র।
বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের কথাই বিবেচনায় আনুন না, দুই টেস্টেই যথাক্রমে ৪৮ এবং ৭২ রানে টপ অর্ডারের তিন স্তম্ভকে হারিয়ে ধুঁকছিল ভারত। তাইজুল ইসলামও ভালোই বল করছিলেন, মাপা লাইন লেংথে ব্যাটারকে খেলার সুযোগই দিচ্ছিলেন না। কিন্তু পান্থ ব্যাটিংয়ে নেমেই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন।
২০১৮ সালে ফিরে যাওয়া যাক। সেবার মইন আলি ডিপ মিড উইকেটে তাঁকে তালুবন্দি করেছিলেন। সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে উন্নতি করেছেন পান্ত। ফিল্ডাররা সীমানায় চলে গেলে তিনি সিংগেল-ডাবলসে মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়ে বিরক্ত করে তুলেছেন।
এরপর একবার সেট হয়ে ফিল্ডার নিয়ে পান্থের কোনো মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। পাওয়ার হিটিংয়ে যেকোনো মাঠেরই সীমানা পার করার সামর্থ্য আছে তাঁর। উইকেটকিপারদের মাঝে কেবল ধোনি এবং গিলক্রিস্টই তাঁর চাইতে বেশি ছয় মেরেছেন।
তবে পান্থও মাঝেমধ্যে বেকায়দায় পড়েন। পেসাররা যদি দারুণ সুইংয়ে ভালো জায়গায় বল করতে পারেন, তাহলে পান্থও রান করতে হিমশিম খান। তবে সেটা খুবই বিরল ঘটনা। প্রতিটা ব্যাটারেরই দুর্বলতা থাকে, তবে নিজের দুর্বলতা বুঝে খেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। উইকেটের চারিদিকে শট খেলতে পারার কারণে বোলারদের টার্গেট জায়গাও কমে যায়। তিনি কাট এবং ড্রাইভের মতো প্রথাগত শট যেমন খেলতে জানেন, তেমনি রিভার্স সুইপ কিংবা রিভার্স র্যাম্পের মতো শট খেলতেও দুবার ভাবেন না।
পান্থ ভবিষ্যতে কতদূর যাবেন সেই প্রশ্নটা আগামীর জন্য তোলা রইলো। তবে ইতোমধ্যেই যে তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরাদের কাতারে পৌঁছে গেছেন, তাঁতে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।