কক্ষপথ থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিলেন। কক্ষচ্যুত হওয়া সে সৈনিকের দাপুটে বিচরণের বোধহয় সবাই শেষ দেখে ফেলেছিলো। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ৬৯ নাম্বার জার্সিটা হয়ে উঠেছিল এক রাশ আক্ষেপের নাম।
তবে, একটু সময় নিয়েই হারিয়ে যাওয়া সেই নায়ক আবার স্বরূপে ফিরলেন। ফেরার জন্য মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে (বিপিএল)। যেখানে সবার চোখ আটকে থাকে। আলোচনার টেবিলে আসতে যেই মঞ্চটাই সবচেয়ে কেন্দ্রিভূত হয়ে থাকে।
এবারের বিপিএলে সেই পাদপ্রদীপের আলোতে নিজেকে জ্বলজ্বল করে তুলে ধরলেন নাসির হোসেন। শুরুতে ঢাকা ডোমিনেটর্সের নেতৃত্ব পেলেন। আগের বিপিএলে দল না পাওয়া ক্রিকেটার এবার একটা দলের অধিনায়ক। সেটি নিয়ে কত টিপ্পনিই না রচিত হলো! ট্রফি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে সেই চলমান ট্রল, টিপ্পনীর আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন নাসির।
অনেকটা অপেশাদার ক্রিকেটারের মতোই এক সাংবাদিককে ঠাট্টার ছলে আক্রমণ করে বসলেন। পরে অবশ্য সরিও বলেছেন। কিন্তু নাসিরকে নিয়ে ট্রলে মেতে থাকা মানুষরা বোধহয় এখনও নাসিরকে ‘সরি’ বলেননি। সেটা নাসিরের জন্য মূখ্য বিষয় না।
কিন্তু, বিপিএল শুরুর আগে যে শরীরী ভাষায় চলেছেন তা মাঠের ক্রিকেটেও নিজের অলরাউন্ড মুনশিয়ানায় দেখিয়েছেন ঠিকঠাকভাবে। ব্যাটে হাতে কিংবা কবজি ঘুরিয়ে- দুই ইউনিটেই দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শুধু দলগত সাফল্যই ধরা দেয়নি নাসিরকে। সেটি বাদে, নাসির ছিলেন এক কথায় দুর্দান্ত। সেই যাত্রায় তিনি শুধু সাকিবকে টেক্কাই দেননি, কখনও কখনও ছাপিয়েও গিয়েছেন।
স্বপ্নময় বিপিএল যাত্রার পর এবার একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে অবধারিতভাবেই। আবারো কি জাতীয় দলে দেখা যাবে মিস্টার ফিনিশারকে? এ নিয়ে স্বয়ং নাসিরের ভাবনা কি? নাসির সম্ভবত এখানেই পেশাদার ক্রিকেটারের মতো চিন্তা করেছেন।
আকাঙ্খা করে নিজের উপর চাপ বাড়াতে চান না। সুযোগ পেলে খেলবেন। দেশের হয়ে আবারো মাঠে ফেরার সাধ কার না থাকে না! নাসিরও সেই দলেরই একজন। কিন্তু প্রত্যাশাটা রাখছেন নিজের পারফর্ম্যান্সের উপর, জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার দিকে নয়।
আর এখানেই অনন্য নাসির। কারণ মাঠের ক্রিকেটে পারফর্ম করলেই জাতীয় দলের সুযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই খুলে যায়। নাসিরও তাই সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করতে চান। যে কোনো ক্রিকেটেই পারফর্ম করাটা তাঁর এখন মূল লক্ষ্য।
এবার আলোচনায় আসা যাক, নাসিরের জন্য সুযোগটা আসলেই কতটা প্রাপ্য? প্রথমত নাসিরের বর্তমান রোলটা একজন ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে। এবারের বিপিএলে যে স্পিন টা তিনি করেছেন তাতে তাঁকে পার্ট টাইম স্পিনারদের কাতারে কোনোভাবেই ফেলা যায় না।
এখন পর্যন্ত বিপিএলের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলার তিনি। এটুকু স্পষ্ট যে, তিনি বোলিং নিয়ে আলাদা করে কাজ করেছেন। এটা নিছকই পার্ট টাইমার হিসেবে হঠাৎ পাওয়া সাফল্য না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নাসির দলে আসলে তিনি কাদের রিপ্লেসমেন্ট হতে পারেন?
এই মুহূর্তে দলে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত নাসিরের মতোই রোল প্লে করেন। শেষ দিকে ব্যাটিং আর টুকটাক বোলিং। নাসিরের জন্য পৌষমাস আর মোসাদ্দেকের জন্য সর্বনাশার ব্যাপারটা হলো, মোসাদ্দেক নিজে একদমই এখন ফর্মে নেই। স্লগে এসে এবারের বিপিএলে প্রায় ম্যাচেই ব্যর্থ হয়েছেন।
তাই নাসিরের কপাল খুলে যেতে পারে মোসাদ্দেকের জায়গাতেই। অবশ্য ম্যানেজমেন্ট, অধিনায়ক কিভাবে ভাবছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই আপাত দৃষ্টিতে নাসিরের দলে ফেরা যতড়া সহজ মনে হচ্ছে ঠিক ততটাও সহজ নয়। সব কিছু ব্যাটে বলে মিললেই তবে নাসির ফিরতে পারেন। এখন সেটা স্বল্প কিংবা দীর্ঘ সময়কালেও গড়াতে পারে।
নাসিরের জন্য অবশ্য আরেকটা পথ খোলা রয়েছে। যে পথে পদধূলি দিচ্ছেন আরো অনেক ক্রিকেটারই। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্রিকেট দলকে একদম ঢেলে সাজাতে চাচ্ছে। সেই পথযাত্রায় তারা খুলে দিয়েছে ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের ব্রাত্য থাকা ক্রিকেটারদের। তারা চাইলেই যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়তে পারে।
এখন পর্যন্ত ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার উন্মুক্ত চাঁদ, ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার লিয়াম প্লাঙ্কেট এই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। এ ছাড়া অনেক পাকিস্তানি ক্রিকেটার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন। এখন নাসির চাইলেই যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করতে পারেন। সেই সুযোগ অবশ্য তিনি এর মধ্যেই পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দল আটলান্টা ফায়ার্স নাসিরকে স্থানীয় ক্রিকেটার হিসেবে চুক্তি করাতে চায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে খেলার বেশ ভাল একটা সম্ভাবনা খুলে যাবে নাসিরের সামনে। নাসির অবশ্য এখনই এ প্রস্তাবে মন গলাতে রাজি নন।
ঘরোয়া লিগে যখন বিরতি থাকবে তখন খেলতে চান সেখানে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দলই প্রথমে থাকছে তাঁর অগ্রাধিকারযোগ্য তালিকায়। আর নাসিরের বয়সটাও এখন বেশি নয়। সবে ৩১। তাই এখনই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে ইতি বলতে চান না তিনি।
তবে সময়ের পরিক্রমায় এই সিদ্ধান্ত অনুমিতভাবেই পাল্টে যেতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এখন মৌসুম জুড়েই ক্রিকেট চলে। সেখানে ক্রিকেটারদের সুবিধাও দেয় হচ্ছে অনেক। তাই বাংলাদেশে নিজের ২.০ ভার্সনে আবির্ভূত না হতে পারলে আমেরিকায় ঘাটি গড়তেই পারেন নাসির।
সেই সম্ভাবনা কোনো ভাবেও উড়িয়ে দেওয়া মতো নয়। তবে এই সব সম্ভাবনা আপাতত সামনের সময়কে ঘিরে। এই মুহূর্তে নাসির নিশ্চিতভাবেই চলমান গতিতে এগোতে চাচ্ছেন। তাতে নিজের ভাগ্য বদল হলে একটা উত্থানের গল্প লেখার অপেক্ষায় থাকবে বাংলাদেশ ক্রিকেট।