লাইভ সাক্ষাৎকারগুলো শুনে মনে হচ্ছে এটা যতটা না ব্যক্তির ভুলগুলো ঠিক করবার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে তার চেয়ে বেশি তাঁদের যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করা হয়, সেগুলো জাস্টিফাই করবার কাজে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে!
হয়তো সাক্ষাতকারগ্রহীতার উদ্দেশ্য সঠিক ছিল। কিন্তু প্রশ্নের ধরনের কারণে সেটা সাক্ষারকার যিনি দিচ্ছেন তাঁর কাছে ফুলটসে ছয় মারার মতো হচ্ছে! এখানে সাক্ষাৎকারগ্রহীতার প্রশ্ন করার ধরন ঠিক করার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকটা উদাহরণ দেই।
- খালেদ মাহমুদ সুজনকে ‘গতিদানব’ বলে অনেকে ট্রল করেন। এ নিয়ে সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হলো যে, সুজন ব্যাপারটার উত্তর দিতে চান কিনা!
সুজন বললেন যে, তিনি তাঁর সীমিত সামর্থ্যে যথাসম্ভব চেষ্টা করে গেছেন। তাঁরা যখন ক্রিকেট খেলেছেন তখন ১৩০ কিমিতে বল করাই অনেক। তিনি তাসকিনের মতো বলতে পারেন না যে ১৪০-১৫০ কিমিতে বল করবেন। তিনি কখনো সেরকম দাবিও করেননি! তাঁদের সময়ে ক্রিকেটে তিনি লেগ কাটার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্র্যাকটিস করে গেছেন। মিডল ওভারে মিডিয়াম পেস বল করে কীভাবে রান আটকানো যায় সেগুলো চিন্তা করেছেন। তাঁদের সুযোগ সুবিধা কম ছিল, তাঁরা তাঁদের হার্ট এন্ড সোল দিয়ে চেষ্টা করেছেন! হয়তো খুব বেশী ম্যাচ জিতেননি। কিন্তু সে সময়ের হিসাবে তাঁদের কষ্টের কমতি ছিল না!
এখানে সুজনের উত্তর খুবই সন্তোষজনক মনে হবে যদি আপনি মূল ঘটনা না জানেন। আসলেই উনারা অনেক কষ্ট করেছেন। এবং তখনকার সময়ে সুজন বা অন্যান্য খেলোয়াড়দের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন করবারও কিছু নাই! আমরা তখন একজন ব্যাটসম্যান একটা বাউন্সারে পুল করলেই অনেক সাহসী মনে করতাম। আমার মনে আছে সুজন এক ম্যাচে কেবল ফিল্ডার সাজিয়ে টানা তিন/চার ওভার মেডেন নিয়েছিলেন। সেটা সেই মিডিয়াম পেস বোলিং দিয়েই! তাঁদের এই সীমিত সামর্থ্য নিয়ে তাঁরা যা করেছেন তাতে তাঁকে সম্মানই করা হয়। কিন্তু কিছু ট্রল আসে তাঁদের খেলোয়াড়ি জীবনের পরে করা কর্মকাণ্ডের জন্য।
প্রশ্নকর্তার হয়তো জেনে প্রশ্ন করা উচিত ছিল যে, ২০১২-১৩ পর্যন্ত সুজনকে কেউ ‘গতিদানব’ বলতো না। সুজন যখন একসাথে বোর্ডের পাঁচ-ছয়টা পদে বসলেন, অর্থাৎ তিনি অনেকগুলো গদির মালিক, তখন এক ক্রিকেট গ্রুপ ডিসকাশনে তাঁকে প্রথমে ‘গদিমানব’, সেখান থেকে ‘গদিদানব’ বলা হয়। সেটাই পরে তাঁর ছোটোখাটো গড়নের কম গতির বোলিংয়ের কারণে ‘গতিদানব’ হয়ে যায়! (একসময়ের বিখ্যাত ব্লগার শূন্য আরণ্যক/ ইমতিয়াজ মির্জা ভাই এই নাম দিয়েছিলেন।)
অথচ সাক্ষাৎকার শুনে মনে হচ্ছে, একজন হার্ডওয়ার্কিং খেলোয়াড়কে শুধুমাত্র তাঁর সীমিত সামর্থ্যের খেলার কারণে ট্রল করা হয়! সুজনের ক্ষেত্রে করা ট্রল আর ইমরুল কায়েসের ক্ষেত্রে করা ট্রলের কারণ এক না! এইটা বুঝতে হবে।
(ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনোই কাউকে এসব ট্রল নামে ডাকি না। এখানে নামকরণের পিছনের ঘটনা ব্যাখ্যা করলাম।)
- শামীম আশরাফ চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হলো, “তিনি অনেক বেশী আননেসেসারি বলেন এটা নিয়ে ট্রল করা হয়। এ নিয়ে শামীম চৌধুরীর মন্তব্য কী?”
শামীম চৌধুরী বললেন, ‘টেলিভিশন দর্শকদের ক্ষেত্রে এনালাইসিস বলতে হয়। আননেসেসারি কখন বলা হয়? যেটা ব্যাটসম্যান না খেললেও পারত, সেটা বোঝানোর জন্যই মাঝেমাঝে এই শব্দ ব্যবহার করি। অনেকের হয়ত এটা কানে লেগেছে। কিন্তু আমি এই শব্দ বলা থেকে বিরত থাকবো না। আপনি পছন্দ করুন আর না-ই করুন, যেখানে আননেসেসারি বলার প্রয়োজন হবে সেখানে আমি বলতেই থাকবো।’
– খুব ভালো কথা। ব্যাটসম্যান যখন আননেসেসারি শট খেলবে তখন তো ধারাভাষ্যকার আননেসেসারি বলবেনই! এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নাই।
কিন্তু প্রশ্নকর্তার খুব স্পেসিফিকভাবে জিজ্ঞেস করতে পারতেন যে, ‘টেস্ট ক্রিকেটে মাহমুদুল্লাহ হ্যাটট্রিক বলে যখন অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে ব্যাট চালাতে গিয়ে হ্যাটট্রিক উপহার দিয়ে আসে তখন হাজারবার আননেসেসারি বলা যায়, ক্রাইম বলা যায়। সেটা নিয়ে সমালোচনা নেই। কিন্তু আপনি তো যখন ৫ ওভারে ৫০ রান দরকার তখনও কোন ব্যাটসম্যান ছক্কা মারতে গেলে আননেসেসারি বলেন, যখন শেষ ওভারে হাতে ৪-৫ উইকেট নিয়ে কোন ব্যাটসম্যান রানরেট বাড়ানোর উদ্দেশ্যে হিট করতে গিয়ে আউট হয় তখনও আননেসেসারি বলেন! এইটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?’
তখন শামীম আশরাফ চৌধুরীর উত্তর কী হতো সেটা শোনাটা বেশী যৌক্তিক হতো।
- তামিম শেষ কয় বছরে শুরুতে অনেক স্লো ব্যাটিং করেন। এ কারণে দলের রানরেটে ঝামেলা হয়। এ নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে প্রশ্নকর্তা যেন তামিমের স্ট্যাটের মিস ইউজ দেখালেন!
তামিমও খুব জাস্টিফাই করলেন। কেন উইলিয়ামসনের বিশ্বকাপের স্ট্রাইক রেটের কথা বললেন। তামিম নিজে বললেন যে, ওয়ানডেতে গত ৮ সেঞ্চুরির ৬-৭টাতে বাংলাদেশ জিতেছে!- ইত্যাদি ইত্যাদি!
অথচ প্রশ্নকর্তার খুব স্পেসিফিকভাবে দেখানো উচিত ছিল যে, কেন উইলিয়ামসন বিশ্বকাপে কোন উইকেটে সাউথ আফ্রিকার সাথে স্লো খেলে শেষ ওভারে চেজ করে জিতেছে আর ব্যাটিং পাটা উইকেটে কী করেছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পাটা উইকেটে তামিমের স্লো সেঞ্চুরিতে ফলাফল কী হয়েছে বা সেমিফাইনালে ভারতের সাথে কী হয়েছে। বিশ্বকাপে ৩০০+ সব টার্গেট ম্যাচে সৌম্যের উপর ওপেনিংয়ে কী পরিমাণ প্রেশার গেছে তামিমের স্লো ব্যাটিংয়ের কারণে।- এগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো উচিত ছিল!
ইংল্যান্ডের পিচে তাদের সাথে বৈশ্বিক ট্রফিতে ১৪২ বলে ১২৮ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে তাঁদের মাটিতে ১৬০ বলে ১৩০ এক জিনিস না! দ্বিতীয়টাতে ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা থাকলেও প্রথমটাতে যায় না! টিটুয়েন্টিতে প্রথম ৬ ওভারের রোল কী হয় অন্যান্য ওপেনারের সেটা জানা দরকার। এখানে ‘অ্যাংকরিং রোল’ প্লে করে বড় দলের সাথে আসলে কী লাভ হয়েছে- এগুলো একেবারে স্ট্যাট খুঁজে প্রিপারেশন নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত ছিল। তখন হয়তো তামিম নিজের রোল জাস্টিফাই করতে কী বলতেন সেটা শোনা যেতো।
আরও কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যেতো। আপাতত থাক।
যাই হোক, সাক্ষাৎকারগুলোতে সাক্ষাৎকার দেয়া ব্যক্তি সমালোচনার প্রশ্নগুলো পেলে নিজেকে যেন শুধরে নিতে পারেন- সেটা হলে ভালো। সব সমালোচনা একেবারে বেইসলেস হয় না। তাই প্রশ্নগুলো আরও ডিটেইল্ড স্পেসিফিক হওয়া উচিত। যেন সমালোচনার ব্যক্তি উত্তরে পাশ কাটিয়ে না যেতে পারেন।