২৫ জুলাই ২০০৩। কেয়ার্নসের বুন্ডাবার্গ রাম স্টেডিয়াম ক্রিকেটের ইতিহাসে নব্বইতম টেস্ট ভেন্যু হিসেবে যাত্রা শুরু করলো। ম্যাচটা ছিল বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার। অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের পেসার আনোয়ার হোসেন মনিরের। সেই টেস্টেই গ্লেন ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলদের বিপক্ষে ৭৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন হান্নান সরকার।
বাংলাদেশের ২৯৫ রানের জবাবে চার উইকেট হারিয়ে ৫৫৬ রানের পাহাড় গড়েছিল অজিরা। স্বাগতিকদের ইনিংসে ছিল তিন সেঞ্চুরি ও দু’টি হাফ সেঞ্চুরি। ম্যাথু হেইডেন ৫০, রিকি পন্টিং ৫৯ করেছিলেন। মিডল অর্ডারে ড্যারেন লেহম্যান ১৭৭ করেন। স্টিভ ওয়াহ অপরাজিত থাকেন ১৫৬ রানে।
আরেক ব্যাটসম্যানও এরপর নেমে ১০০ রান করে অপরাজিত ছিলেন ১৫৬ বলে। সেটা ছিল সেই ব্যাটসম্যানের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ সেঞ্চুরি। কে জানতো, সেটাই তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট হয়ে থাকবে।
তিনি হলেন মার্টিন লাভ। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের নেক্সট বিগ থিঙ হিসেবে বিবেচিত হতেন তিনি। অথচ, খেলতে পারলেন মাত্র পাঁচ টেস্ট। তাতে ব্যাটিং গড় মন্দ ছিল না। এক সেঞ্চুরি এক হাফ সেঞ্চুরির ক্যারিয়ারে রান তুলেছেন ৪৬.৬০ গড়ে। অভিষেকে হাফ সেঞ্চুরি, শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি – এটাই তাঁর ক্যারিয়ার হাইলাইটস।
বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই টেস্টটা তাঁর খেলা হত না, যদি ডেমিয়েন মার্টিন ইনজুরিতে না পড়তেন। ডেমিয়েন মার্টিন ফেরার পর আবার তিনি জায়গা হারান। আর ফিরতে পারেননি। ফিরবেন কি করে? ঘরোয়া ক্রিকেটে যখন সুসময়ে ছিলেন – তখন মিডল অর্ডারে স্টিভ ওয়াহ, ড্যারেন লেহম্যান, ডেমিয়েন মার্টিনরা আছেন।
সেখানে লাভকে ভালবাসার সুযোগ কোথায় অজিদের। আজকের দিনে হলে হয়তো, দিব্যি ৪০-৫০ টা টেস্ট অন্তত খেলে ফেলতে পারতেন। কিংবা কে জানে, যে প্রতিভা নিয়ে তিনি এসেছিলেন আরো অনেকদিনই হয়তো সার্ভিস দিতে পারতেন জাতীয় দলকে।
কি তাঁর প্রতিভা? প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর রান প্রায় ১৭ হাজার। সেঞ্চুরি ৪৫ টি, হাফ সেঞ্চুরি ৭৮ টি। সর্বোচ্চ ইনিংসটা ৩০০ রানের। ২০০৯ সালে মেলবোর্নে কুইন্সল্যান্ডের হয়ে শেষবার যখন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাঠে নামেন সেবারও প্রথম ইনিংসে ৪১, দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ১০৪ রান।
মার্টিন লাভের লড়াইটা আসলে শুরু সেই নব্বই দশক থেকেই। ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে তাঁর প্রথম শ্রেণির অভিষেক হয় শেফিল্ড শিল্ডের ফাইনাল ম্যাচে। টানা ১৮ বছর তিনি সার্ভিস দিয়ে গেছেন কুইন্সল্যান্ড। সেটার দাবিদার ছিল অস্ট্রেলিয়াও, কিন্তু, সময়মত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া সেই দাবি তুলতেই পারলো না।
১৯৯৪-৯৫ মৌসুমের শেফিল্ড শিল্ড ফাইনালে তিনি ১৪৬ রানের ইনিংস খেলেন, যার সুবাদে দীর্ঘ ৬৮ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শিরোপা জিতে নেয় কুইন্সল্যান্ড। সেটা ছিল কিংবদন্তি অ্যালান বোর্ডারের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। কিংবদন্তির বিদায়টা স্মরণীয় করেছিলেন লাভ। তবুও, লাভকে কেউ ভালবাসেনি।
ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসেও যে সেঞ্চুরিটা করেন – সেটাও ছিল আরেকটা ফাইনাল। লাভ ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের বড় ম্যাচের পারফরমার। লম্বা সময় ক্রিজে টিকে থাকতে জানতেন, ব্যাকফুটে তাঁর পাঞ্চগুলো ছিল ঐশ্বরিক। লাভকে ভালবেসেছিল শেফিল্ড শিল্ড, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ছিলেন ব্রাত্য।
লাভ অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি হতে না পারলেও তিনি ছিলেন কুইন্সল্যান্ডের কিংবদন্তি। দলটির হয়ে ২০০৬-০৭ মৌসুমে তিনি ১০ হাজার রানের মাইলফলক ছাড়িয়ে যান। কু্ইন্সল্যান্ডার হিসেবে স্টুয়ার্ট ল’র সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভাঙেন।
প্রায় ১০ বছর ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার পর ২০০২ সালে লাভের জন্য একটা জায়গা তৈরি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দলে। ওই সময় মার্ক ওয়াহ’র ছেড়ে যাওয়া জায়গাটা তাঁকে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। অ্যাশেজের আগে সফরকারী ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে টানা দুই ডাবল সেঞ্চুরি সেই আশার বেলুন ফুলিয়ে দিচ্ছিলো আরো।
মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্টে অভিষেক। অভিষেকেই হাফ সেঞ্চুরি। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ার ওই সময়কার দলটাই এমন প্রতিভাবান পারফরমারে বোঝাই যে – একটা ভুলের মাশুল বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। সিডনি টেস্টে ডাক, পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে রান খরা, বাংলাদেশের বিপক্ষে ডারউইনে ডাক – ভুলের অধ্যায় ক্রমেই বড় হচ্ছিল লাভের। বাংলাদেশের বিপক্ষে কেয়ার্নসের সেঞ্চুরিও সেই ভুলের মাশুল হতে পারেননি। লাভ তাই আর কখনোই ভালবাসার নায়ক হতে পারেননি।