বিরক্তিকর-কৃপণ-কার্যকর

জায়গা মত টানা বোলিং করে যেতে পারতেন, ব্যাটসম্যানদের ধৈর্য ধরে থাকার বাঁধ ভাঙতেন। নেটে লম্বা সময় নাদকার্নির সঙ্গী ছিল একটা কয়েন। সেই কয়েনটা উইকেটে রাখতেন একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। আর বারবার সেই কয়েনের ওপর বল ফেলতেন। এটা তাকে আরো বেশি লক্ষ্যভেদী করে তুলেছিল।

১৯৩৩ সালের চার এপ্রিল। এই দিনে ভারতের নাসিকে জন্মগ্রহণ করেন ক্রিকেটের প্রাচীনতম ‘ইউটিলিটি ক্রিকেটার’ বা মিনি অলরাউন্ডারদের একজন। তিনি হলেন বাপু নাদকার্নি। পুরো নাম রামেশচন্দ্র গঙ্গারাম ‘বাপু’ নাদকার্নি।

সে যুগের মিনি অলরাউন্ডাররা এখনকার মত স্লগ ওভারে বল করতেন না, বা ইনিংসের শেষের দিকে ১৫০-এর ওপর স্ট্রাইকরেটে তিনটে ছক্কা, দু’টো চার মেরে বিদায় নিতেন না। এরা অত্যন্ত বোরিং প্রজাতির ক্রিকেটার ছিলেন।

তাঁদের ব্যাটিং ছিল ডিফেন্স সর্বস্ব, বোলিং-এ তাঁদের মূল অস্ত্র ছিল লাইন আর লেন্থ; স্ট্রাইক বোলারদের উইকেট পাওয়ার সুযোগ করে দিতেন এরা। তবে এযুগের মিনি অলরাউন্ডারদের মতই অসাধারণ ফিল্ডার ছিলেন এরা। ট্রেভর বেইলি থেকে রবি শাস্ত্রী, স্কিল নয় গাটসের জন্যই এরা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আজীবন।

তবে বাপু নাদকার্নি বাকিদের থেকে একটু আলাদা। ইতিহাস মনে রাখবে ক্রিকেটের ইতিহাসে কৃপণতম বোলারদের একজন হিসেবে। ১৯৬৪ সালের ১০ জানুয়ারি চেন্নাইতে শুরু হওয়া টেস্ট ম্যাচে এই স্লো লেফট আর্ম বোলার ৩২ ওভার বোলিং করে ৫ রান দেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই টেস্টে ২৭ টি মেইডেন ছিল তাঁর।

এর মধ্যে টানা ১৩১ বল (২১টি মেইডেন) কোন রান দেননি তিনি। ৫৪ বছরের বেশি সময় কেটে গেছে,  তাঁর এই অসামান্য কীর্তির রেকর্ড টিকে আছে আদৌ। উইকেট কিন্তু পাননি একটিও। মুম্বাইতে পরের টেস্টেই তার বোলিং ফিগার ১৪ ওভার, ১১ মেইডেন, ৩ রান, উইকেট পাননি এবারও। উইকেট নয়, তাঁকে চিনতে হবে মেইডেন ওভার দিয়ে।

জায়গা মত টানা বোলিং করে যেতে পারতেন, ব্যাটসম্যানদের ধৈর্য ধরে থাকার বাঁধ ভাঙতেন। নেটে লম্বা সময় নাদকার্নির সঙ্গী ছিল একটা কয়েন। সেই কয়েনটা উইকেটে রাখতেন একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। আর বারবার সেই কয়েনের ওপর বল ফেলতেন। এটা তাকে আরো বেশি লক্ষ্যভেদী করে তুলেছিল।

ক্যারিয়ার ইকোনমি ১.৬৭, গড় ২৯.০৭ কিন্তু স্ট্রাইক রেট ১০৪.১; পরিসংখ্যানই বলছে কতটা কিপ্টে ছিলেন তিনি। ভারত দেশের মাটিতে এক পেসার, চার স্পিনার খেলানোর স্ট্র্যাটেজি শুরু করে বিখ্যাত স্পিন কোয়াট্রেটরা দলে আসার আগে থেকেই, আর নাড়কার্নি এই লাইনাপের অপরিহার্য অংশ ছিলেন।

ব্যাট হাতেও আনাড়ি ছিলেন না তিনি। প্রথম শ্রেণী ক্রিকেটে গড় ৪০ এর বেশি, সর্বোচ্চ স্কোর প্রায় তিনশর কাছাকাছি। ইংল্যান্ডের সাথে ওই একই সিরিজের শেষ ম্যাচে প্রথম ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১২২ রানের ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ইনিংস খেলেন এই অলরাউন্ডার। ভারত ফলোঅনে পড়েছিল সে ম্যাচে, নাড়কার্নির ইনিংসটিই ম্যাচ বাঁচায়। ৫ টেস্টের সিরিজ ড্র হয় ০-০ ব্যবধানে।

অবশ্য সালটা ১৯৬৪, ২০১৮ নয়; তাই ‘টেস্ট ক্রিকেটের দিন শেষ’ বলে শোরগোল তোলেনি কেউ। বর্তমান সময়ে প্রশ্ন তোলা হয়। সে কারণেই কি না, এখনকার দিনে বাপু নাদকার্নিদের দেখা মিলে না। টেস্ট ক্রিকেটের চিরায়ত সৌন্দর্যও বিলীন হয়ে গেছে অনেক আগেই।

পরবর্তীতে ভারতীয় জাতীয় দলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা নাদকার্নি ছিলেন স্বয়ং সুনীল গাভাস্কারের মেন্টর। কথায় কথায় প্রায়ই নাকি বলতেন, ‘ছোড়ো মাত!’ মানে, ‘হাল ছেড়ো না!’ বোঝাই যায় – উইকেটে কামড়ে থাকার মানসিকতাটা গাভাস্কার কোথা থেকে শিখেছেন!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...