মুশফিক-রিয়াদদের স্ট্রাইকরেট কেন বাংলাদেশের হুমকির কারণ!

প্রত্যাশার পারদ ছিল তুঙ্গে। হবেই বা না কেন? শেষ সাত বছরে ঘরের মাটিতে যে দলটা এক প্রকার অপরাজেয়, সেই দলটাকে নিয়ে তো উচ্চাশা করাই যায়। কিন্তু প্রত্যাশা কিংবা উচ্চাশা, কোনোটাই পূরণ হয়নি। সব নিমেষেই মিলিয়ে গিয়েছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ পরেই। অবশ্য শেষ ম্যাচে একটা স্বান্ত্বণার জয় অবশেষে এসেছে। অন্তত শূন্য অর্জনে সিরিজ শেষ করতে হয়নি টাইগারদের।

তবে এই ম্যাচ জেতার পরই জিজ্ঞাসু মনে একটা প্রশ্নের আবেশে ঘিরে ধরে- আরেকটু পরিকল্পনা অনু্যায়ী খেললে সিরিজটা কি জিততে পারতো না বাংলাদেশ? পরিকল্পনার গলদটা ঠিক কোথায়? সম্পূরক প্রশ্ন এর সাথেই আবার চলে আসে।

সিরিজের প্রথম ম্যাচটা বাংলাদেশ এক মালানের কাছেই হেরেছে। এ কথা এক বাক্যে মেনে নিতে আপত্তি নেই। আবার দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ তো ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারেনি। তিন ম্যাচের সিরিজ তো এখানেই শেষ। তারপরও কিছু ভুল তো অবশ্যই দুই দলের মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি করেছে।

দুই দলের টপ অর্ডারদের কথাই ধরা যাক। সোজা কথায়, সিরিজটা ইংলিশ শিবির পকেটে পুরেছে ঐ টপঅর্ডারদের আগ্রাসনেই। প্রথম ম্যাচে মালান, তো পরের ম্যাচে জেসন রয়। আর এই জায়গাটাতেই ডাহা ফেল করেছেন বাংলাদেশের টপ অর্ডাররা। লিটন দাস তো পুরো সিরিজ এক প্রকার ছায়ার মতো হয়ে ছিলেন। আর তামিম ইকবার যে কটা রান করেছেন তাতে বরং সামগ্রিকভাবে দলের ক্ষতিই হয়েছে।

দ্বিতীয় ম্যাচে ৩২৭ রানের লক্ষ্যে নেমে তিনি খেলেছেন ৬৫ বলে ৩৫ রানের ইনিংস। দলের ক্ষতি বোঝানোর সম্ভবত এই ইনিংসের বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন নেই। নাজমুল হোসেন শান্ত দুটো ফিফটি পেয়েছেন। মন্দের ভাল হিসেবে বাহবা পাচ্ছেন অনুমিতভাবেই।

কিন্তু সিরিজের স্ট্যান্ডার্ড বিবেচনায় সেই দুই ফিফটির এক ফিফটি দলের সামান্যও কাজে আসেনি। পুরো সিরিজে ব্যাট করেছেন মাত্র ৭৭ স্ট্রাইকরেটে। শান্তর ক্ষেত্রে স্ট্রাইকরেট ধর্তব্যে না আনলেও আরেকটি জায়গায় তিনি ঠিকই ইংলিশ ব্যাটারদের থেকে পিছিয়ে পড়েন।

এ ক্ষেত্রে, ডেভিড মালানের কথা টেনে আনা যেতে পারে। প্রথম ম্যাচে প্রচুর ডট দিয়েছেন। কিন্তু ডেভিড মালান যখন মন্থর গতিতে ইনিংস এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর দলের সামনে মাত্র ২১০ রানের লক্ষ্য। তাই মালানের তাড়াহুড়ো ব্যাটিং না করলেও চলতো।

কিন্তু শান্ত প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৮২ বলে খেললেন ৫৮ রানের ইনিংস। এতেও কোনো দোষ খোঁজার কারণ নেই। কিন্তু সে ইনিংসটা যে তিনি বড়ো করতে পারলেন না সেখানেই মূলত সমালোচনার জায়গাটা তৈরি হয়। একই সাথে, সিরিজের ব্যবধানটাও গড়ে গিয়েছে এখানে।

এই সিরিজে চারে ব্যাট করেছেন মুশফিকুর রহিম। শেষ ম্যাচে ৭০ রানের ইনিংস বাদ দিলে বাকি দুই ম্যাচে এক প্রকার নিষ্প্রভই ছিলেন তিনি। প্রথম ম্যাচে ব্যাট করেছেন ৫০ স্ট্রাইকরেটে, আর দ্বিতীয় ম্যাচে উইকেটে থিতু হওয়ার আগেই ফিরে গিয়েছেন।

এখন অনেকেই একটা অকাট্য যুক্তি দিতে পারেন, উইকেট স্লো ছিল। এমন উইকেট রান করা কঠিন। কিন্তু সিরিজের চিত্র বলে, জশ বাটলার, রয়, মইন আলীরা ঠিকই স্ট্রাইক রোটেট করে খেলতে পেরেছেন। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই তো বাটলার ৬৪ বলে ৭৬ রানের একটি কার্যকরী ইনিংস খেলেছিলেন।

একইভাবে, মইন আলীও সে ম্যাচে শেষ দিকে ৪০ রানের গুরুত্বপূর্ণ একটা ইনিংস খেলেছিলেন। ইংলিশরা আক্রমণাত্বক ক্রিকেট খেলতে অভ্যস্ত, এই ব্যাখ্যা দিয়ে মুশফিক, শান্তদের পার পাইয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দলের আরেক ব্যাটার সাকিবও তো ঐ একই উইকেটে খেলেছেন। প্রতি ম্যাচেই রানের জন্য ছুটেছেন। ঝুঁকি নিয়েছেন। তাতে সফলও হয়েছেন। বাংলাদেশের হয়ে সিরিজে সর্বোচ্চ রান তাঁরই।

কিন্তু সাকিবের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারে কেউ না কেউ প্রতি ম্যাচে আক্রমণাত্বক ক্রিকেট খেলেছেন। যা মিডল অর্ডার ব্যাটারদের জন্য কাজটা সহজ করে দিয়েছিল। কিন্তু সাকিব টপ অর্ডার কোনো ব্যাটার থেকে তেমন কোনো সঙ্গ পাননি, এমনকি লোয়ার মিডল অর্ডার কোনো ব্যাটার সাকিবের সাথে অ্যাংকরিং রোলও প্লে করতে পারেননি। সাকিবকে তাই নিঃসঙ্গ হয়েই ইনিংস টেনে নিয়ে যেতে হয়েছে।

মূলত পিচের দায়টা নিজেদের দুর্বলতা আড়াল করার উপায় মাত্র। মূল সমস্যাটা ব্যাটারদের অ্যাপ্রোচে। আবার অনেকখানি মানসিকতারও দায় আছে। দলের সেরা ওপেনার ব্যাট করছেন মাত্র ৬৫ ব্যাটিং স্ট্রাইকরেটে। তামিম প্রেস কনফারেন্সে এসে যতই বুলি ফোটাক, এমন রক্ষণাত্বক ভঙ্গির ব্যাটিংয়ের স্রেফ কোনো ব্যাখ্যা নেই।

গোটা সিরিজে দলের প্রধান ওপেনারের ভূমিকা যেখানে প্রায় শুন্যের কোঠায় , সেখানে এক ধাপ প্রথমেই পিছিয়ে যায় দল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। নেতিবাচক ক্রিকেটীয় কৌশলেই মাশুল দিতে হলো শেষ পর্যন্ত। অবশ্য এখান থেকে উত্তরণের পথটা যে সহসায় তৈরি হয়ে যাবে, বিষয়টা মোটেই তেমন নয়।

বরং, এমন কিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলে সিরিজ হারের পুনরাবৃত্তিও অব্যাহত থাকবে। সাকিবের একার নৈপুন্যে হয়তো কয়েকটা ম্যাচ জেতা সম্ভব। কিন্তু সিরিজ জিততে হলে প্রয়োজন ইতিবাচক ক্রিকেট কৌশল, সাথে দলগত পারফরম্যান্স। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ দুইয়ের মিশেল দেখা যায় না বললেই চলে।

হোম সিরিজে অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ, এই ট্যাগলাইনই বোধহয় একটা তৃপ্ততা এনে দেয়। আর এই তৃপ্ততাতেই আড়াল হয় সূক্ষ্ম অনেক গলদ। সামনের সময়ে এমন সব গলদ যত কমবে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্যযাত্রা ঠিক একই হারে বাড়বে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link