আজকাল বর্ণবাদ ইস্যুতে বেশ সরব বিশ্ব। খেলাধুলার অঙ্গনেও লেগেছে এর আগুন। এখন আইসিসি নিয়ম করে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশ করেছে যার পোশাকি নাম ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস’। অথচ, একটা সময় বর্ণবাদ ইস্যুতে কি সংগ্রামই না করতে হত এই সংখ্যালঘু ক্রিকেটারদের।
তেমনই একজনের গল্প বলা যাক আজ। পুরো নাম ফিলিপ অ্যান্থনি জেসন ডিফ্রেইটাস। ছোট করে বললে ফিল ডিফ্রেইটাস। আজকাল ক্রিকেট ভক্তরা হয়তো তাঁকে চিনবেন না, তবে নব্বইয়ের দশকের খোঁজ খবর রাখলে তিনি খুব অপরিচিত কেউ নন।
মাত্র বিশ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, তাও অ্যাশেজে, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। অদ্ভুত এক বোলিং অ্যাকশন। কিভাবে যেন বলটা ছোড়ার আগে দুই হাত ওপরে তুলতেন। হ্যাঁ, বোলিং অ্যাকশনটা খুব দর্শনীয় না হলেও নব্বই-একানব্বইয়ের দিকে তিনি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ধারাবাহিক পেসার ছিলেন। ইনসুইঙ্গার আর লেগ কাটারগুলো দারুণ করতেন।
১৯৯২ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। তবে, দিনকে দিন আগুনটা কমে আসছিল। ১৯৯৫ সালে যখন ডোমিনিক কর্ক চলে আসলেন, তখন টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় ডিফ্রেইটাসের।
ব্যাটিংয়ের কথা যদি বলি, তাহলে বলতেই হয় যে বয়সের সাথে সাথে পরিণত হচ্ছিল তাঁর ব্যাট। যদিও, ২৩ তম ম্যাচের আগে কোনো হাফ সেঞ্চুরির দেখা পাননি। বেশ পেটাতে পারতেন, তবে ইয়ান বোথাম পরবর্তী যুগে ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডারের অভাব কখনোই দূর করতে পারেননি তিনি।
তবে, এটা ঠিক যে জাতীয় দলে টিকে থাকতে মাঠে ও মাঠের বাইরে নিদারুণ সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। এখানে বড় একটা ভূমিকা রাখে তাঁর গায়ের রং। কৃষ্ণাঙ্গ বলে খোদ ইংলিশরাই নাকি খুন করতে চেয়েছিল তাঁকে।
স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে ডিফ্রেইটাস বলেছিলেন, ‘আমি দুই থেকে তিনবার চিঠি পেয়েছিলাম, সেখানে আমাকে বলা হয় – আমি যদি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলি তাহলে আমাকে গুলি করা হবে। বাড়িতে পুলিশী নজরদারী রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার গাড়িতে আমার নিজের নাম লেখা ছিল, সেটা সরাতে হয়েছে। টেস্ট শুরুর দু’দিন আগে টিম হোটেলে উঠতাম, ভাবতাব খেলবো কি খেলবো না। ওরা আমাকে স্নাইপার দিয়ে গুলি করবে না তো। এই অবস্থায় কিভাবে ক্রিকেটে মনোযোগ রাখবো। তবে, আমি পেরেছিলাম। আমার তীব্র ইচ্ছাশক্তি ছিল। ওদের কাছে আমি হেরে যাইনি।’
মৃত্যুর হুমকি পেয়েও, ইংল্যান্ডের হয়ে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ৪৪ টি টেস্ট এবং ১০৩ টি ওয়ানডে খেলেছেন ডিফ্রেইটাস। ব্যাট হাতে টেস্টে ১৪.৮২ গড়ে ৯৩৪ রান করেন তিনি। এছাড়া ৩৩.৫৭ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ১৪০ টি। বোঝাই যাচ্ছে বর্ণবাদের কড়া থাবার মধ্যে থেকেও ক্যারিয়ার নিয়ে ছিলেন দারুণ সচেতন।
ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে ১৬.০৪ গড়ে ৬৯০ রান ও বল হাতে ১১৫ উইকেটও শিকার করেন ডিফ্রেইটাস। কাউন্টি ক্রিকেট খেলেছেন ২০ বছর। ক্যারিয়ারের বড় সময় কাটান লিস্টারশায়ার। যদিও, শুরু করেন লিস্টারশায়ারেই, সেখান থেকে ল্যাঙ্কাশায়ারে, এরপর ডার্বিশায়ারে ছিলেন। ক্যারিয়ার শেষ করেন লিস্টারশায়ারেই।
চ্যালেঞ্জ তাঁর সব জায়গাতেই ছিল। ডিফ্রেইটাস বলেন, ‘ক্রিকেট খেলতে নিজের জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। তবে মৃত্যুর ভয় মাথায় নিয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলাটা আমার জন্য অনেক কঠিনই ছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমার দৃঢ় সংকল্প ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে খেলেছি। সেই মানুষগুলোর কাছে কোনভাবেই হার মানতে চাইনি।’
শুধুমাত্র মৃত্যুর হুমকিই নয়, ইংল্যান্ড দলে সুযোগ পেতে শ্বেতাঙ্গদের বিপক্ষে লড়াই করতে হয়েছে ডিফ্রেইটাসকে। তিনি জানান, ‘আমি সব সময় মনে করতাম, দলে সুযোগ পেতে হলে শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারদের থেকে আমাকে দ্বিগুণ ভালো খেলতে হবে। তারা আমাকে কখনোই স্বাগত জানাতো না। প্রতিবার আমরা মনে হয়েছে, এবারই ইংল্যান্ডের হয়ে হয়তো আমার শেষ ম্যাচ। আমি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার জন্য মরিয়া ছিলাম এবং এই দৃঢ়তাই আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে।’
একাদশে সুযোগ পাবার পরও ঝামেলার সম্মুখীন হন ডিফ্রেইটাস। তার পারফরমেন্সের কোন সুনাম করতো না দলের অন্যান্য খেলোয়াড়রা। তাই নিজেই নিজেকে সাহস দিতেন ডিফ্রেইটাস। তিনি বলেন, ‘আমাকে কেউ সহায়তা করেনি। দলে আমার কোনো সমর্থন ছিল না। আমার সমর্থক আমি নিজেই ছিলাম। আমার মা সব সময় বলতেন, কখনোই ভাববে না যে তুমি এদের কেউ নও। তারপরও আমি ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যা অর্জন করেছি, এতে আমি গর্বিত।’
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন তিনি ১৯৯৭ সালে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ – টানা তিনটি বিশ্বকাপ খেলেন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁকে পিটিয়ে ছাতু করে দেন শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া। তাতে বিশ্বকাপে যেমন ইংল্যান্ডের বিদায় ঘণ্টা বাজে, তেমনি ডিফ্রেইটাসের ক্যারিয়ারেরও বিদায় ঘণ্টা বেজে যায়। আর খুনের হুমকি নিয়ে টিকে থাকাটাও তাঁর জন্য সহজ ছিল না।