আইপিএলে বরাবরই দারুণ সমন্বয়-পূর্ণ স্কোয়াড তৈরি করে কলকাতা নাইট রাইডার্স। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নতুন পুরনোদের মিশেলে লড়াই করার মতো দল গড়েছে কেকেআর। ২০১৪ সালে শেষবার আইপিএল শিরোপা ঘরে তুলেছিল কলকাতা। এরপরের ৮ আসরে একবার ফাইনালে উঠলেও আর চ্যাম্পিয়ন হওয়া হয়নি দলটার। তাই দু’বারের চ্যাম্পিয়ন কলকাতা নাইট রাইডার্সের এবারের মিশন ৮ বছরের শিরোপা খরা কাটানো। রাইডার্স শিবির কি সেই পথে হাঁটতে পারবে? দলটার সক্ষমতা, সম্ভাবনা, সমস্যা নিয়ে চলুন বিশ্লেষণে লেগে পড়া যাক।
- ব্যাটিং
এবারে দেশি বিদেশিদের সমন্বয়ে দারুণ এক ব্যাটিং লাইনআপ সাজিয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। নিয়মিত অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ার প্রথম কয়েকটা ম্যাচে না থাকলেও শক্ত বিকল্প রয়েছে কলকাতার স্কোয়াডে। দলটাতে ইনিংস শুরু করার দৌড়ে রয়েছেন নারায়ণ জগদীশান, ভেঙ্কটেশ আইয়ার, লিটন দাস আর রহমানুল্লাহ গুরবাজ। খুব সম্ভবত নারায়ন জগদীশানকেই ইনিংস শুরুর দায়িত্ব দিবে টিম ম্যানেজমেন্ট। তাঁর সাথে উদ্বোধনী জুটিতে থাকতে পারেন লিটন দাস অথবা রহমানুল্লাহ গুরবাজ।
ভেঙ্কেটাশ আইয়ার ওপেনার হলেও সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে তিনি তিন/চারে খেলেই সফল হয়েছেন। তাই ভেঙ্কেটাশ আইয়ারকে তিন অথবা চার নম্বরে দেখা যেতে পারে একাদশে। অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন নিতিশ রানা তিনে খেললে ভেঙ্কেটাশ আইয়ারের পজিশন নেমে যেতে পারে চারে।
পাঁচ নম্বরে খেলতে পারেন রিঙ্কু সিং অথবা মন্দিপ সিং। তবে শ্রেয়াস আইয়ার ইনজুরি থেকে ফিরলে আবার তাঁকে একাদশ থেকে জায়গা হারাতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে শ্রেয়াস আইয়ারকে তিনে জায়গা দিতে গিয়ে নিতিশ রানা আর ভেঙ্কেটাশ আইয়ারকে আবার এক ধাপ নিচে নেমে ব্যাট করতে হবে।
৬ নম্বরে অটোমেটিক চয়েস হিসেবে দেখা যাবে আন্দ্রে রাসেলকে। অবশ্য ম্যাচ পরিস্থিতিতে তাঁর অবস্থানের পরিবর্তনও ঘটতে পারে। রাসেলের পর লোয়ার অর্ডারে দেখা থাকছে সুনীল নারাইন আর শার্দুল ঠাকুর। মূলত এই তিনজনের কাঁধেই স্লগ ওভারে পাওয়ার হিটিংয়ের দায়িত্ব থাকবে।
- বোলিং
ব্যাটিং লাইনআপের মতো অবশ্য কলকাতার বোলিং লাইনআপ অতোটা সমৃদ্ধ নয়। যদিও সুনীল নারাইন দলে রয়েছেন তারপরও ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট কোনো পেসার দলে নেই। কলকাতার জার্সি গায়ে এবার পেস আক্রমণ সামলাবেন উমেশ যাদব, লকি ফার্গুসন, টিম সাউদি, শার্দুল ঠাকুররা। তবে ডেথ ওভারে তাদের শেষ ৪ আইপিএলের পরিসংখ্যান বেশ বিবর্ণ।
এ তিন পেসারই শেষ আসরগুলোতে শেষের ওভার গুলোতে প্রচুর রান দিয়েছেন। ডেথ ওভারে উমেশ যাদবের ইকোনমি ১২ এর উপরে, ১২.২২। বাকি দুই পেসারের ক্ষেত্রেও এ চিত্রটা সুখকর নয়। লকি ফার্গুসন প্রায় ১০ ইকোনমি রেটে বল করেছেন আর শার্দুল ঠাকুর কিছুটা মন্দের ভালো, ৯.২৮ ইকোনমিতে বল করেছেন।
এখন একাদশে বোলিং লাইন আপ কেমন হবে তা নির্ভর করবে কন্ডিশনের উপর। আন্দ্রে রাসেল নিয়মিতই বল করে থাকেন। সে হিসেবে কলকাতার টিম ম্যানেজমেন্ট ৩ স্পিনারের অপশনও ভাবতে পারে। সে ক্ষেত্রে নারাইন, বরুণ চক্রবর্তীর সাথে তৃতীয় স্পিনার হিসেবে জায়গা মিলতে পারে সাকিবের। অবশ্য ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দাপিয়ে বেড়ানো ডেভিড ভিসাও একাদশে বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে ঢুকে যেতে পারেন। প্রোটিয়া এ অলরাউন্ডার বল করার পাশাপাশি স্লগ হিটিংয়েও দারুণ দক্ষ।
তারপরও সাকিব, ভিসা- দুজনকেই একাদশে সুযোগ পেতে বেশ কাঠখড়ই পোড়াতে হবে। বরং শুরুর একাদশে এ দুই অলরাউন্ডারের সুযোগ না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তো কলকাতার একাদশে বোলিং লাইনআপ হতে পারে অনেকটা এমন- টিম সাউদি অথবা ফার্গুসনের মধ্যে একজন, শার্দুল ঠাকুর, উমেশ যাদব, নারাইন আর বরুণ চক্রবর্তী।
- সম্ভাব্য একাদশ
নারায়ণ জগদীশান, রহমানুল্লাহ গুরবাজ/ লিটন দাস, নিতিশ রান, ভেঙ্কটেশ আইয়ার, রিংকু সিং (শ্রেয়াস আইয়ারের বিকল্প সাপেক্ষে), আন্দ্রে রাসেল, শার্দুল ঠাকুর, সুনীল নারাইন, টিম সাউদি/ লকি ফার্গুসন, উমেশ যাদব, বরুণ চক্রবর্তী।
- সাকিব-লিটনের একাদশে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কেমন?
টিম কম্বিনেশনের কারণে সাকিবের চেয়ে এবার লিটনের একাদশে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ বিদেশি চারজনের কোটায় নারাইন, আন্দ্রে রাসেল দুজনই অটো চয়েস। সে ক্ষেত্রে বাকি দুজনের জন্য ওপেনার পজিশন আর পেসারদের মধ্যেই লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর এই বিবেচনায় লিটন অথবা গুরবাজের মধ্যে কেউ একজন সুযোগ পাবেন। এই মুহূর্তে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন লিটন। সেই ধারাবাহিকতায় লিটন কলকাতার একাদশে শুরু থেকেই সুযোগ পেতে পারেন। অবশ্য বিসিবি অনাপত্তি পত্র দিতে বাঁধ সাধলে গুরবাজ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই একাদশে সুযোগ পাবেন।
তবে সাকিবের পথও অন্যদিক দিয়ে খোলা রয়েছে। টিম ম্যানেজমেন্টে অতিরিক্ত স্পিনারের কথা বিবেচনা করলে সাকিবের সুযোগ মিলবে। আবার বিদেশি ওপেনারের স্থলে ভেঙ্কটেশ আইয়ারকে দিয়ে ইনিংস শুরু করা হলে মিডল অর্ডারে আসতে পারেন সাকিব। তবে সে সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত বেশ ক্ষীণই বটে। অন্তত এটা এক প্রকার নিশ্চিতই যে, সাকিব, লিটন একসাথে একাদশে সুযোগ পাবেন না।
- কলকাতার ট্রাম্পকার্ড
কলকাতার এই স্কোয়াডে বরাবরের মতো বেশ কিছু ম্যাচ উইনার রয়েছেন। আন্দ্রে রাসেল কিংবা নারাইন- যে কেউ নিজেদের দিনে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারেন। তবে এবারের ট্রাম্পকার্ড হতে পারেন নতুন সংযোজন নারায়ণ জগদীশান। তামিলনাডুর এ ব্যাটারের লম্বা ইনিংস খেলার সামর্থ্য রয়েছে। বিজয় হাজারে ট্রফিতে মাস চারেক আগেই অরুণাচল প্রদেশের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৪১ বলে ২৭৭ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস। যেটি ভেঙ্গে দেয় লিস্ট এ ক্রিকেটের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের আগের রেকর্ড।
কলকাতা শিবিরে আরেক তুরুপের তাস চন্দ্রকান্ত পন্ডিত। তাঁর রোলটা অবশ্য খেলোয়াড় হিসেবে নয়। তিনি আটবেন ম্যাচ জয়ের রণকৌশল। কোচ হিসেবে দারুণ সফল চন্দ্রকান্ত পন্ডিত। রঞ্জি ট্রফিতে সব মিলিয়ে ৬ বার কোচ হিসেবে শিরোপা জিতেছেন। মধ্য প্রদেশের এ কোচের জানা আছে, কিভাবে শিরোপা জিততে হয়। তাই চন্দ্রকান্ত পন্ডিতের রণকৌশলেই দীর্ঘ শিরোপা খরা ঘুচানোর দিকে চোখ থাকবে কলকাতার সমর্থকদের।
কলকাতার এ স্কোয়াডের শিরোপা জয়ের সামর্থ্য আছে। তবে এর বিপরীতে কিছু দুর্বলতার জায়গাও আছে। অবশ্য সেটি কাটিয়ে ওঠার সুযোগও তাদের সামনে রয়েছে। তবে স্কোয়াড যেমনই হোক না কেন, মাঠের ক্রিকেটে পারফর্ম করাটাই মূখ্য ব্যাপার। সেটিই একটা দলকে জয় এনে দেয়, পাশাপাশি সব সময় দলকে চাঙা রাখতে সাহায্য করে। আর ধারাবাহিক জয়ের এ টনিকেই একটা দল শিরোপার পথে এগিয়ে যায়। কলকাতা নাইট রাইডার্স সেই পথের অভিযাত্রী হবে কিনা, তা সময় গড়ালেই উপলব্ধ হবে।