অঙ্কে জ্ঞান-বুদ্ধির দৈন্যদশা দেখে মাস্টারমশাই আমাকে বলেছিলেন, ‘হেড দিয়া দিয়া মাথা খারাপ হইয়্যা গ্যাছে গিয়া। বাবা রে গিয়া বল, নামটা চেঞ্জ কইরা দিতে।’ এ আমার স্কুলজীবনের ঘটনা। মাস্টারমশাই খেলা-বিরোধী ছিলেন।
আরও পরে এক অগ্রজ স্নেহ পরবশ হয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘খেলে কী হবে? শুধু খেলা আর খেলা। বয়স পেড়িয়ে যাচ্ছে তবু খেলা। আমি যদি কোনও জায়গার হেড হতাম তাহলে খেলাধুলো বিভাগটাই তুলে দিতাম।’ এ আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। সেই অগ্রজ অবশ্য আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। মজা করেই হয়ত কথাগুলো বলেছিলেন।
তারও আগে পেশায় আমার থেকে সিনিয়র আরেক উন্নাসিক অগ্রজকে বলতে শুনেছিলাম, ‘খেলোয়াড় কি সাহিত্য লিখতে পারবে?’ খেলার সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড়দের প্রতিও সেই অগ্রজ কী কারণে যে অ্যালার্জি ছিল, তা আজও বোধগম্য হয়নি আমার।
কাল শেষ ওভারে রিঙ্কু সিং যখন একের পর এক ছক্কা মারছিলেন, খাদের কিনারায় চলে যাওয়া একটা দলকে একাই টেনে তুলছিলেন, তখন বিভিন্ন সময়ে শোনা অগ্রজদের কথাগুলোই মনে পড়ছিল।
সত্যি তো খেলোয়াড় কবিতা লিখতে পারেন না, সাহিত্য রচনা তাঁর অভিধানে নেই, রসায়নের দুরূহ ফর্মুলাও তাঁর বা তাঁদের অজানা, পদার্থবিদ্যাও বিষম বস্তু তাঁদের কাছে।
ভাবছিলাম রিঙ্কু সিংদের মতো সাধারণ থেকে অসাধারণের কক্ষে পা রাখা ক্রীড়াবিদদের নিয়েই তো লেখা হয় কবিতা। তাঁদের মাঠের ভিতরের ও বাইরের লড়াই নিয়ে লেখা হয় কথাসাহিত্য। গানের লেখায়, সুরে চলে আসেন তাঁরা অবধারিতভাবে।
ছোট্ট মহল্লা থেকে রাজ্য হয়ে দেশের সীমারেখা অতিক্রম করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তাঁদের নাম। ছড়িয়ে পড়ে সুবাস। হয়ে ওঠেন একেক জন আইকন।
মাঠের ভিতরে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ক্যাচ ধরতে পারেন, ব্যাট হাতে গভীর দু:সময়ে ছক্কার পর ছক্কা হাঁকাতে পারেন, পেনাল্টি বক্সের ভিতরে পায়ের জঙ্গল কাটিয়ে বিপক্ষের জালে বল জড়াতে পারেন।
জীবনের হার্ডলগুলো সবুজ মাঠেই যেন হয়ে যায় একেক জন প্রতিপক্ষ। চলে তাদের টপকানোর খেলা। তাঁদের দেহ-বর্ণ-সৌন্দর্য চলে যায় পিছনের সারিতে। সামনে চলে আসে তাঁদের সৃষ্ট রূপকথা।
ঠিক যেমন রিঙ্কু সিং। তারকা সুলভ চেহারা মোটেও নয়। নামটাও যেন কীরকম! অবশ্য নামে কীইবা যায় আসে। কাল শেষ ছক্কা হাঁকিয়ে যখন ডাগ আউটের দিকে দৌঁড়চ্ছিলেন, তখন দেখলাম দৌঁড়ের স্টেপে গন্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। ওই ছোট্ট গন্ডগোলে শরীরের ভারসাম্য সামান্য নড়ে যাওয়াই ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, কতটা উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে তাঁকে দৌঁড়তে হয়েছে জীবনের দৌঁড়।
কেকেআর যে ছবিটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছে, সেটা ভাল করে দেখছিলাম। সবার মুখ বেরঙিন। রিঙ্কু সিংয়ের মুখটা অসম্ভব উজ্জ্বল।
খেলার অব্যবহিত পরে তাঁর বক্তব্যগুলো আরও উজ্জ্বল করে তুলছিল রিঙ্কুর ব্যক্তিত্বকে। রক্তের গতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। বলছিলেন, ‘একেকটা ছক্কা আমার পাশে থাকা মেহনতী মানুষদের জন্য। একেকটা ছক্কা আমার বাবার জন্য।’
রিঙ্কুর বাবা গ্যাস সিলিন্ডার ডেলিভারি দিতেন। ছেলেদের খেলতে যেতে দিতেন না। লাঠি নিয়ে বাড়ির বাইরে বসে থাকতেন। একবার কানপুরে খেলতে যাওয়ার জন্য রিঙ্কুর মা পাশের দোকান থেকে হাজার টাকা ধার করে এনে দিয়েছিলেন। এক টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে একটা বাইক পেয়েছিলেন রিঙ্কু। তা দেখার পর থেকে রিঙ্কুর বাবা লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করা বন্ধ করে দেন। এগুলো কোনও না কোনও সময়ে রিঙ্কুই বলেছিলেন।
আইপিএলের নিলামে তাঁর দর আশি লাখ হওয়ার পরে যা বলেছিলেন, তাতে ফুটে ওঠে পরিবারের প্রতি গভীর ভালবাসা। ‘কিছু টাকা দিয়ে দাদার বিয়ে দেব। কিছু টাকা রেখে দেব বোনের বিয়ের জন্য আর কিছু টাকা দিয়ে ঘর বানাবো।’
আলিগড় থেকে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আইপিএলের বৃত্তে। এক ভিডিওয় দেখছিলাম, ছেলের বাড়ি তৈরি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন রিঙ্কুর মা। চোখের জল লুকিয়ে রিঙ্কু বলছিলেন, ‘প্রথম বার মাকে দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি তৈরি দেখছে।’
কোন ঘরে কোন পুরস্কার রাখবেন, তাও স্থির করে ফেলেছেন রিঙ্কু। আর ছেলেবেলা থেকে পাওয়া অপমান, বঞ্চনাগুলোকে কোথায় রাখবেন এই নাইট?
রবিবারের রাত এক নায়কের আবির্ভাব দেখল। এক সাধারণের অসাধারণ হয়ে ওঠাও চোখের সামনে ফ্রেম-বন্দি হয়ে থাকল। শুধুমাত্র বিপন্ন দলকে জেতানো নয়, জীবনের কঠিন ম্যাচ জেতার নামও রিঙ্কু। সব মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত। অনিশ্চয়তায় ভরা দিক-ভ্রষ্ট একটা পরিবারকে অ্যাটলাসের মতো কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছেন এই খর্বকায় নাইট।
ওই ব্যাট হাতে ছক্কা মারার ক্ষমতাই তাঁকে অন্ধকার থেকে আলোয় এনেছে। তাঁর পরিবারকেও। রিঙ্কুদের মতো ক্রীড়াবিদদের জন্যই খেলার বিশ্ব আজও আলোকময়। সাফল্য তাঁদের পিছনে ছোটে। অর্থ ধাওয়া করে।
সব দেখে শুনে সেই সব অগ্রজদেরই আমার এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে, ‘খেলে কী হবে? খেলোয়াড় হয়ে কী হয়? ক্রীড়া সাংবাদিকতা করেই বা কী হবে?’