ন্যাপোলির ঈশ্বর, ঝাঁকড়া চুলের সেই দশ নম্বর

১০ মে, ১৯৮৭।

ন্যাপলস স্টেশনে নামলেন দুই আমেরিকান পর্যটক। অবাক বিস্ময়ে দেখলেন সারা স্টেশন, যতদূর চোখ যায়, হালকা নীল রঙের পতাকা, স্কার্ফ, ব্যানার ভর্তি, সর্বত্র লাগানো।

‘আজ এখানে একটা বড় কিছু হতে চলেছে!’, এক পর্যটক বলে উঠলেন অবাক হয়ে!

ন্যাপলস! ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে শহরের মানুষ খাবার আর জলের অভাবে হাহাকার করে উঠেছিল আশির দশকে তারাই কাগজের নিত্য শিরোনাম হয়ে উঠল কুখ্যাত ট্রাফিক জ্যাম, বেকারত্ব আর ক্যামোরা মাফিয়াদের জন্য।

নাপোলি এর আগে কখনও আনন্দ করার সুযোগ পায়নি, না তো তারা কোনদিন পেয়েছে উৎসব করার কারণ। এক বছর দু’বছর নয়, দীর্ঘ ৬০ বছর অপেক্ষা করেছে ন্যাপলসের ন্যাপোলি! তাঁদের প্রথম লিগ জয়ের জন্য!

যে দল অবনমন বাঁচানোর লড়াই করেছে প্রতিবার, আজ তারাই লিগ জয়ের দাবিদার। লিগের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি ন্যাপোলি আর ফিওরেন্তিনা। ড্র বা জিতলেই চ্যাম্পিয়ন ন্যাপোলি!

২৯ মিনিটে গোল করলেন কারনিভেল। উল্লাসে ফেটে পড়ল ৮২০০০ দর্শক। পরে এক তরুণ খেলোয়াড় বিপক্ষে গোল করলেও ম্যাচ ড্রয়ের সুবাদে চ্যাম্পিয়ন হল ন্যাপোলি।

পরের দিন ম্যাচ রিপোর্টে প্রথম পাতায় লেখা হল, ন্যাপোলির উল্লাস মাউন্ট ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতের চেয়েও বেশি জোরালো ইতালীয় ফুটবলে! কিন্তু যার জন্য এই অবিশ্বাস্য ম্যারাথন লিগ জয়? তিনি কোথায়?

ম্যাচের পর ঘর্মাক্ত দেহে প্রেস বক্সের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। দু’হাত দিয়ে ফ্লাইং কিস সমর্থক দের দেবার পর তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বললেন তিনি, ‘এটা তোমাদের জন্যই!’

ডিয়েগো ম্যারাডোনা। চরম দারিদ্র থেকে উঠে আসা ছেলেটা আজ কিং অব ন্যাপলস!

৫ জুলাই ১৯৮৪, ম্যারাডোনা যোগ দিলেন ন্যাপোলিতে ৭৫০০০ দর্শকের সামনে। প্রখ্যাত লেখক ডেভিড গোল্ডব্লাট বলেছিলেন সমর্থকরা প্রথম দিন থেকেই রক্ষাকর্তা বানিয়ে ফেলেছিলেন ম্যারাডোনাকে।

ম্যারাডোনা এমন সময়ে ন্যাপোলিতে আসেন যখন ইতালি ও বিশ্ব ফুটবল শাসন করছে চার ইতালিয়ান দৈত্য। এসি মিলান, ইন্টার মিলান, জুভেন্টাস আর এএস রোমা।

তবে ন্যাপোলিতে ম্যারাডোনার প্রভাব বাড়তে সময় লাগেনি। খুব দ্রুতই ব্রুসকোলোত্তির থেকে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড আসে ম্যারাডোনার হাতে। তাঁর অধিনায়কত্বেই প্রথম ইতালিয়ান লিগ আসে নাপোলির ঘরে। মিথ হয়ে যান মারাদোনা ও আরও দুজন। মারাদোনা, জিওর্ডানো আর কারেকা মিলে তৈরি করেন মা-জি-কা (MA-GI-CA)।

নাপোলির পারফরম্যান্সের উত্থান হতে থাকে উল্কার গতিতে। কোপা ইতালিয়া, ইতালিয়ান সুপারকাপ সবই আসে ন্যাপোলির ঘরে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে যখন ন্যাপোলির মুকুটে যোগ হয় উয়েফা কাপের পালক। সেই সময়ে ম্যারাডোনা ছিলেন ক্লাবের সর্বকালের সেরা গোলদাতার ১১৫ টি গোল করে। পরে অবশ্য হামসিক তাঁর রেকর্ড ভাঙেন।

তবে ম্যারাডোনার মাহাত্ম্য রেকর্ডে নয়, বরং তাঁর বিপক্ষে খেলা কিংবদন্তিদের মন্তব্যে বোঝা সম্ভব। কিংবদন্তি ফ্রাঙ্কো বারেসি, পাওলো মালদিনি প্রত্যেকেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন তাঁদের দেখা সবচেয়ে টাফ ফুটবলারের নাম দিয়েগো ম্যারাডোনা।

তবে ডিয়েগোর জীবনের মতনই ন্যাপোলির অভিজ্ঞতায় চড়াই উৎরাই কম ছিল না। এর কারণ হিসেবে উঠে আসে অনেকগুলি কারণ। যার একটি কমন কারণ তুলে ধরেছিলেন জিমি বার্নস বা প্যাডি অ্যাগনিউ।

ম্যারাডোনার ইমেজ ও স্টারডম। যার বাজার ধরতে চেয়েছিলেন সবাই। তা সে আর্জেন্টিনা প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেম হোক, কি ফিফা হোক, কি আন্তর্জাতিক মিডিয়া হোক কিংবা তাঁর বন্ধু কাম এজেন্ট সিটার্সপিলার হন,উদ্দেশ্য সবারই এক। অর্থ উপার্জন। পরে সিটার্সপিলারকে সরিয়ে যাকে নিয়ে এলেন,সেই গিলারমো কোপোলা ছিলেন আরও ধান্দাবাজ। ম্যারাডোনার সরলতার সুযোগ নিয়ে মারাদোনাকে চালনা করলেন আরও ভুল পথে।

ন্যাপোলিতে ম্যারাডোনার সাথে ইতালিয়ান মিডিয়ায় সম্পর্ক খুব একটা সুখকর ছিল না। ম্যারাডোনা এমনিতেই কোন প্রোটোকলের ধার ধারতেন না। প্রেস কনফারেন্সে মিডিয়াকে দাঁড় করিয়ে রাখায় চটে গিয়ে বহু সাংবাদিকই চলে গিয়েছিলেন তাঁর বিপক্ষে। ন্যাপোলির সাংবাদিকদের বক্তব্য ছিল খুব পরিস্কার, ‘আমাদের লিগ টেবিলের ওপরে রাখো, তোমার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন নিয়ে একটা কথাও বলা হবে না।’

কিন্তু তাতেও বাদ সাধল ন্যাপোলিরই নিউক্লিও মোবাইল। তাঁদের তোলা রিপোর্টে প্রকাশিত হল ম্যারাডোনার বন্ধুত্ব গিউলিয়ানো পরিবারের সাথে, সেই পরিবার যারা ইতালিয়ান অসামাজিক কাজকর্মের সাথে প্রবল ভাবে জড়িত। গোয়েন্দা বিভাগের হাতে এলো প্রায় ৭১ টি ছবি যাতে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনদের সাথে মারাডোনার ঘনিষ্ঠতার পরিচয় আরও দৃঢ় হল।

সেখানে ম্যারাডোনা কখনও ডনদের সাথে রেঁস্তোরায় বা কখনও তাদের পরিবারের বিয়ের রিসেপশনে নিয়মিত মুখ। ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাফিয়ারো ডি রানোর সামনে অবশ্য গোটাটাই ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন দিয়েগো। তবে অপরাধ জগতের সাথে ফুটবলের রাজপুত্রর যোগাযোগ নিয়ে সারা দেশ তখন উত্তাল। ২০০৫ সালে কুখ্যাত গিউলিয়ানো মারা যান গ্যাঙ ওয়ারে।

১৯৮৭ তে লিগ জয়ের পর ন্যাপোলিতে আসা আর্জেন্টাইন সাংবাদিকদের বলা একটা ঘটনা অনেক পরে বহুল চর্চিত হয়। লিগ জয়ের পর যখন সবাই আনন্দে উদ্বেল,মারাদোনা বলেন তাঁদের বাইরে নির্দিষ্ট এক জায়গায় দাঁড়াতে যেখানে তাঁদের পিক আপ করা হবে একটা পার্টির জন্য।

তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় নোলা বলে একটা জায়গায়,যেটা নাপোলি শহরের থেকে একটু দূরে। বিশাল প্রাসাদে গিয়ে সাংবাদিকরা দেখেন চারপাশে উদ্দাম পার্টি চলছে। এবং মাঝে একটা বিশালাকৃতি টিভি ,যাতে দেখানো হচ্ছে ম্যারাডোনার সর্বকালের সেরা গোলগুলো।

কৌতূহলী সাংবাদিকরা উপস্থিত ব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করলেও পার্টির হোস্ট কে সেই নিয়ে সেইদিন কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, সেই পার্টির হোস্ট ছিলেন কুখ্যাত ক্যামোরা গ্যাঙয়ের এক গডফাদার।

 

বিতর্ক ও সাফল্য দুটিই ম্যারাডোনার সাথে সমানতালে চলেছে। তবে ক্রিশ্চিয়ানা সিনাগ্রার ঘটনাটি ইতালিকে আশির দশকের শেষের দিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটাই। স্টেট টিভি নিউজের সামনে এসে ২২ বছরের অ্যাকাউন্ট্যান্ট দাবি করে বসলেন, ম্যারাডোনা তাঁর সন্তানের পিতা। যদিও সেই সময় জনমত মারাদোনার দিকে থাকলেও ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়েছিল যথেষ্ট। নয় বছর পর ১৯৯৫ তে তীব্র আইনি লড়াইয়ের পর দিয়েগো মেনে নেন সেটি সন্তানের পিতৃত্ব। যদিও এর পরেও জলঘোলা হয় বিস্তর।

তবে শুধুই কি বিতর্ক আর ট্রফি? ম্যারাডোনার গুরুত্ব ছিল নাপোলির কাছে আরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলতেন মারাদোনা আসলে ছিলেন ন্যাপোলির লাইফ লাইন। তাঁর আসার পরের প্রথম দু’বছরের টিকিট বিক্রি ছাপিয়ে গিয়েছিল আগের ২৪ বছরের মোট টিকিট বিক্রি ন্যাপোলি ক্লাবে। স্যাটেলাইট টিভি আসার আগে ক্লাবগুলো কে অনেকটাই ভরসা করতে হত গেট সেলের ওপর। বক্স অফিসের বিক্রি প্রথম বছরেই দ্বিগুণ হয়ে যায় যে টাকায় ম্যারাডোনাকে নেওয়া হয়েছিল বার্সার থেকে। ডিয়েগো যখন নাপোলি ছাড়েন তখন নাপোলির পকেটে গেট সেল ,স্পনসরশিপ থেকেই পাওয়া অর্থমূল্য ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড।

তাই ডিয়েগো রাজা একটি মধ্যমমানের দল নাপোলিকে ফুটবল মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য।সেই ন্যাপোলি ও ন্যাপোলির বাসিন্দারা, যাদের অভিজাত ইতালিয়ানরা নিজেরাই ধরতেন না মানুষ হিসেবে।

সান জেননারো, ন্যাপোলির একমাত্র সেন্ট ছিলেন যাকে গোটা নাপোলির মানুষ ‘দেবতা’ বলে মানেন তার আত্মত্যাগের জন্য। বলা হয়ে থাকে তাঁর রক্ত আজও একটি রুপোলী পাত্রে রাখা আছে নেপলস ক্যথিড্রালে।

তাকেও জনপ্রিয়তায় কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনে ফেলে দিয়েছিলেন ভিল্লা ফিওরিতোর বস্তির ছেলেটি। সেজন্যই আজও নারীসঙ্গ, সুরা, কোকেন সবকিছু ছাপিয়েই ন্যাপোলির ঈশ্বর ঝাঁকড়া চুলের সেই দশ নম্বর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link