২৫ জুন ১৯৮৩। নয় নয় করে তা স্বাধীন ভারত আজ মধ্য তিরিশের যুবক। তবুও কেন জানিনা জন্মলগ্নে যে আশাবাদের, যে প্রত্যাশার পারদ আবেগের উত্তাপে ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্কের দ্রুতগতিতে ছুটছিল তা যেন আজ বরং উল্টোদিকে ধাবমান। ক্রমবর্ধমান সামাজিক – রাজনৈতিক – অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত দেশবাসী প্রকৃতির নিয়মে স্বাধীনতার রূপকারদের হারিয়ে, দেশ বা জাতি হিসাবে ক্রমান্বয়ে বিশ্বের দরবারে কৌলিন্য না জোটাতে পেরে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় হীনমন্যতায় ভুগছিল। এমন সময়েই এলো ১৯৮৩ সালের ২৫ জুনের রাত।
রাতই বটে। যে দেশটা দু দুটো শতক ধরে আমাদের দেশটাকে শাসন করলো থুড়ি শোষণ করলো সেই নাক উঁচু লালমুখোগুলোর ক্রিকেটীয় ঐতিহ্যের বারান্দায় বিশ্বজয়ের স্মারক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রান্তীয় জলবায়ুর রোদে তাপে পোড়া বাদামি চামড়ার আমার আপনার এক সহনাগরিক – কিন্তু আজও দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের মোড় ঘোরানো মাইলস্টোনটা ফিরে দেখতে আমরা যখন ইউটিউবে ঢুঁ মারি তখন তো দেখি লর্ডসের ব্যালকনিতে বিশ্বজয়ীর ট্রফি হাতে দাঁড়ানো হরিয়ানা হ্যারিকেনের সারল্য মাখা হাসিতে টেমস পাড়ের পড়ন্ত বিকেলের রোদের আভা। তাহলে, ‘রাত’ আসলো কোথা থেকে।
আসলে মশাই, ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তটা যখন জন্ম নিচ্ছে তখন তো আমাদের এই বিশ্বজয়ী দেশটার পঁচাত্তর কোটি নাগরিক রাতের আহার সারছেন।
যেমন ধরুন মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে জন্মানো বছর দশেকের ছেলেটা তখন তার খুড়তুতো ভাইদের সাথে ছুটি কাটাচ্ছিল। সবে সবে ক্রিকেটে আগ্রহ জন্মানো ছেলেটা ফাইনালের দিন আগ্রহভরে টিভিতে চোখ রেখেছিল। কিন্তু, সুনীল গাভাস্কার অল্প রানে ফিরতেই কিশোরটি হতাশ হয়ে পড়ে। সে ভাবতেই পারেনি অপ্রতিরোধ্য ক্যারিবিয়ানদের সামনে মাত্র ১৮৪ রানের টার্গেট ধোপে টিকবে বলে।
কিন্তু, ঐতিহাসিক সেমি ফাইনাল ও ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ মহিন্দর অমরনাথের বলে দীর্ঘদেহী ফাস্ট বোলার মাইকেল হোল্ডিং লেগ বিফোর হতেই জয়োচ্ছ্বাসে মেতে ওঠা কিশোরটি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল ওই বাইশ গজে তাকে ব্যাট হাতে শতরান করতেই হবে। ২০১১ সালে ক্রিকেট কেরিয়ারের সায়াহ্নে পৌঁছে সেই ছেলেটাই ঐতিহ্যশালী লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তুললেন। জানেন সেদিনের সেই কিশোরটি কে?
‘ইন্দিরা নগরের গুন্ডা’ রাহুল দ্রাবিড়।
আবার যদি আমরা ওই রাতে মধ্যপ্রদেশ থেকে সিটি অব জয়ে পাড়ি দিয়ে বেহালার এক অভিজাত পরিবারের ড্রইং রুমে ঢুঁ মারি তো দেখবো ফুটবল ভক্ত বছর দশেকের এক কিশোর ক্রীড়ানুরাগী বাবা ও ক্রিকেট শিক্ষার্থী দাদার সাথে বসে গোলিয়াথকে হারিয়ে ডেভিডের যুদ্ধজয় দেখে ক্রিকেটে আগ্রহ অনুভব করা শুরু করলো। ওই রাতের পর ডান হাতি ছেলেটা বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান দাদাকে দেখে বাঁ হাতে ব্যাট তুলে নিল এবং পরবর্তীতে তর্কাতীতভাবে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানের শিরোপা অর্জন করলো। চিনতে পারছেন সেই বাঙালি কিশোরটিকে?
জিওফ্রে বয়কটের প্রিয় ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’ সৌরভ গাঙ্গুলি।
আচ্ছা ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আর ভারতীয় ক্রিকেটের মক্কা মুম্বাই আলোচনায় আসবে না তাই কখনো হয় নাকি ? চলুন এবার দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীর পূর্ব বান্দ্রার সাহিত্য সহবাস কলোনিতে কলোনির কিশোরদের ওই রাতটা কেমন কেটেছিল জেনে দেখি। সাহিত্য সহবাস কলোনির একপাল বিচ্ছু একসাথে বসে ম্যাচটা দেখছিল। সব ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যে করে দিয়ে ক্যারিবিয়ানদের একের পর এক রথী মহারথীরা প্যাভিলিয়নে ফিরে যাচ্ছিলেন আর ছেলেগুলো আনন্দে নেচে উঠছিল।
ওই দলে বছর দশেকের এক ঝাঁকড়া চুলের ছেলে ছিল। ছেলেটার ক্রিকেটের থেকেও লন টেনিসে এবং বিশেষ করে ঝাঁকড়া চুলের মার্কিন টেনিস স্টার জন ম্যাকেনরোর প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু, ওই রাতটা ওই ছেলেটার খেলার স্বাদ বদলে দিল। ছেলেটা প্রিয় মেজ দাদার হাত ধরে শিবাজি পার্কের আচরেকর স্যারের ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে নাম লেখালো। বড় হয়ে সেদিনের সেই ঝাঁকড়া চুলের মারাঠি ছেলেটা ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানশিপের হেন রেকর্ড বই নেই যাতে নাম লেখায় নি। চিনতে পারছেন ছেলেটাকে?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আমরা বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারের কথা বলছি।
আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেটের ব্রহ্মা – বিষ্ণু – মহেশ্বর তথা শচীন – সৌরভ – রাহুলের মত এই দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে থাকা গোটা একটা প্রজন্ম দিনবদলের স্বপ্ন দেখেছিল ওই রাতে। গোটা একটা দেশের খেলাধুলার মানচিত্রটাই রাতারাতি দেশভাগের মানচিত্রের মত বদলে গিয়েছিল ওই একটা রাতে। হকির কৌলিন্য, ফুটবলের ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্যকে বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে গোটা একটা জাতিকে ক্রিকেট পাগলে পরিণত করেছিল ওই একটা রাত, দীর্ঘদিন শ্রেষ্টত্বের আসন হারানো মাত্র তিন দশক আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখা একটা হীনমন্যতায় ভোগা জাতিকে বিশ্বজয়ের স্বাদ চাখিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে চোখে চোখ রেখে প্রথম বিশ্বের সাথে লড়ার রসদ জুগিয়েছিল ওই রাতটাই – দিনবদলের রাত।