এক দশক পর হিসাবের খাতা নিয়ে সকলেই বসছেন। আমরাও বসি। তবে দশক সেরা দল অনেকেই বানাচ্ছেন, তাই সেই পথ দিয়ে হাঁটছি না। টেস্ট ও ওয়ানডের নিরিখে, দশকের সেরা পাঁচ ম্যাচ, সেরা পাঁচ ইনিংস, সেরা পাঁচ স্পেল ইত্যাদি বেছে নেবো।
আজকের আয়োজন ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা পাঁচ ইনিংস। আগেই বলে রাখছি, যা আগের পর্বেও বলেছিলাম, দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিদেশীয় এমনকি এশিয়া কাপ জাতীয় টুর্নামেন্টের চেয়ে বরাবর বিশ্বকাপে বেশি চাপ থাকে, এবং বিশ্বকাপের,ম্যাচে একটা ৩৫ বা ৪৫ একটা দ্বিপাক্ষিক সিরিজের ওয়ানডের ২০০’র চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। আর দেরি না করে তবে শুরু করা যাক।
- কেভিন ও’ব্রায়েনের (আয়ারল্যান্ড) ৬৩ বলে ১১৩
প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ব্যাঙ্গালুরু, ২০১১ বিশ্বকাপ
আয়ারল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড, প্রকৃতিগত ভাবে প্রায় এক দেশ হলেও, রাজনৈতিক ভাবে প্রায় সর্প-নকুল সম। খানিকটা ভারত পাকিস্তানের মতোই। আয়ারল্যান্ড বরাবর ইংল্যান্ডের ছায়ায় থাকা ব্রিটিশ দ্বীপের এক ছোট্ট রাষ্ট্র। স্বভাবতই, ক্রিকেটেও ইংল্যান্ডের থেকে কয়েক আলোকবর্ষ পিছিয়ে। কিন্তু সেই বিশ্বকাপে আইরিশরা যেন নতুন ভাবে নিজেদের আবিষ্কার করেছিল, ইংল্যান্ডের ছায়া থেকে বেরিয়ে ক্রিকেট মহাকাশে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিল। এবং সৌজন্যে ছিল কেভিন ও’ব্রায়েনের সেই ইনিংস।
বিশ্বকাপে সেইসময় দ্রুততম শতরান, এবং পরিস্থিতি কি? না ৩২৮ তাড়া করে ২২ ওভারে ১০৬ রানে ৪ উইকেট। অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা কথা এখানে না বলে পারছিনা, সেই ১১৩ রানের মাহাত্ত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো মার্ক নিকোলাসের ধারাভাষ্য। গ্রায়েম সোয়ানদের যেভাবে তুলে তুলে গ্যালারিতে ফেলেছিলেন ওব্রায়ান, সেরকম তার দু-তিনদিন আগে একই মাঠে শচীন টেন্ডুকারকেও এতো ধারাবাহিকভাবে করতে দেখিনি। ওই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ইনিংস, এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ৮ বছর আগে জন ডেভিসনের একইরকম বিধ্বংসী শতরানের মতো বিয়োগান্ত পরিণতি হয়নি সেই ইনিংসের।
- মাহেলা জয়াবর্ধনের (শ্রীলঙ্কা) ৮৮ বলে ১০৩
প্রতিপক্ষ ভারত, ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল, মুম্বাই
পেলব কব্জির মোচড়, স্পিনের বিরুদ্ধে স্লো উইকেটে দাদাগিরি, অনবরত স্কোরবোর্ড কে সচল রাখা, স্লগ ওভারে কুশলী পেসারদের পেটানো-একটা সুন্দর ওয়ানডে ইনিংসের যে যে গুন্ থাকা দরকার তার সবকটাই অপরিমিত পরিমানে ছিল সেই ইনিংসে।
আর মঞ্চটা একবার ভাবুন-বিশ্বকাপ ফাইনাল, সামনে ভারত এবং বিপক্ষে শুধু এগারো জন নয়, ৩৫০০০ হিংস্র জনতা। জয়াবর্ধেনের শতরান শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের আদর্শ পাটাতন তৈরি করে দিয়েছিলো। যদিও, শেষ অবধি সেই ইনিংসটা ধোপে টেকেনি।
- গৌতম গম্ভীরের (ভারত) ১২০ বলে ৯৭ ও মহেন্দ্র সিং ধোনির (ভারত) ৭৯ বলে ৯১
প্রতিপক্ষ শ্রীলংকা, ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল, মুম্বাই
যদি না এই দুটি ইনিংস থাকতো, তাহলে হয়তো সেদিন বিশ্বকাপ জেতাই হয় না ভারতের। ভারতীয় ক্রিকেট জনতা আজও বিভক্ত এটা নিয়ে যে ২৮ বছর পর বিশ্বকাপ জয়ে কার অবদান বেশি-ধোনি না গম্ভীর? ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, এই দুজনের গাঁথা ইট এই ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের মহল তৈরি হয়েছিল। দুটোর একটা না থাকলেই ভারত বিশ্বকাপ জেতে না।
শচীন, শেবাগ তাড়াতাড়ি আউট হবার পর একটু একটু করে ইনিংসটি থিতু করেছিলেন গম্ভীর। আবার স্কোরবোর্ডকেও সচল রেখেছিলেন যাতে আস্কিং রেট হাতের বাইরে না যায়। আর গম্ভীরের তৈরি ক্যানভাসে শেষের দিকের গুরুত্বপূর্ণ টান গুলি দিয়েছিলেন এমএস ধোনি। এই মিলিত ১৮৮ না থাকলে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের অপেক্ষা এখন হয়তো ৩৮ বছরে পড়তো।
- গ্রান্ট এলিয়টের (নিউজিল্যান্ড) ৭৩ বলে ৮৪
প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, অকল্যান্ড
ডেল স্টেইন, মরনে মরকেল, ইমরান তাহির সামলে ম্যাচটি অনেকদূর তো নিয়ে যাওয়া গেছে। কিন্তু কাপ আর ঠোঁটের দূরত্বের হৃদয়বিদারক উপাখ্যান তো নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে নতুন নয়। এর আগে বহুবার বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলেছে তারা, কিন্তু ফাইনাল? এতদূর ভাবনাও ছিল না।
দুই বলে রান বাকি পাঁচ। বোলিং মার্কে ডেল স্টেইন। গ্যালারিতে ৩০ হাজার উৎসুক জনতা। এই চাপ সবাই নিতে পারেননা। আর বিশেষত তিনি যদি জন্মসূত্রে হন দক্ষিণ আফ্রিকান, তাহলে কঠিন সময়ে চাপে সেদ্ধ হয়ে স্কুল ক্রিকেটের মতো ভুল করা তো তাঁর মজ্জাগত। কিন্তু এলিয়ট পেরেছিলেন। ২ বল লাগেনি, শেষের আগের বলটাই গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেছিলেন এলিয়ট।
দক্ষ ফিনিশারের মতো, অপরদিকে উইকেট পড়া সত্ত্বেও ঘাবড়াননি তিনি। স্কোরবোর্ডকে সচল রেখেছেন, বাজে বলে মেরেছেন। আর তাঁর জন্মভূমির বিরুদ্ধে তাঁর ‘এডপ্টেড’ দেশকে প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছেন, এবং চিরশত্রূ অজিদের প্রায় দুর্ভেধ্য দূর্গ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই ইনিংস যদি দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ না হয়, জানিনা কোনটা হবে।
- বেন স্টোকসের (নিউজিল্যান্ড) ৯৮ বলে ৮৪
প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল, লর্ডস
বেন স্টোকসের জীবদ্দশায় যদি টাইম মেশিন আবিষ্কার হয়, তাহলে হলপ করে বলতে পারি বৃদ্ধ বয়সে তিনি টাইম মেশিনে চেপে গ্যালারিতে বসে ২০১৯ সালের দুটি মহাকাব্য পুনরায় উপভোগ করতে চাইবেন। একটা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হেডিংলি, অপরটা এই ইনিংস। আর দেখতে দেখতে ভাববেন, ‘কিভাবে আমি এগুলো করেছিলাম?’ পেলেকে যেমন অবসরোত্তর জনৈক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি এই ড্রিবল গুলো কিভাবে করতেন?” পেলে উত্তর দেন, ‘আমার নিজেরই জানা নেই।’
ভাগ্যের সহায়তা নিশ্চয় ছিল সেই ইনিংসে, কিন্তু তাতে এই ইনিংসের গরিমা একটুও ক্ষুন্ন হয় না। ক্রিকেটের গোড়াপত্তনকারী দেশকে ৪৪ বছর পর প্রথম বিশ্বকাপ দেয়া এই ইনিংস তাই গুরুত্বে অপরিসীম এবং দশকের শ্রেষ্ঠ।