চেন্নাইয়ের এম চিদাম্বারাম স্টেডিয়ামের গ্যালারি তখন রীতিমত হতাশায় নিমজ্জিত। অস্ট্রেলিয়াকে ১৯৯ রানে আটকে দেওয়ার পর সহজ জয়ের প্রত্যাশাতেই চোখ রেখেছিল ভারতীয় সমর্থকেরা। কিন্তু সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে যে দুর্গতি ভারতীয় ব্যাটারদের উপর ভর করেছিল, তাতে ম্যাচ থেকে ছিটকে যাওয়াই ছিল অনুমেয়।
কিন্তু ভারতকে সেই খাদের কিনারা থেকে পরে টেনে তোলেন বিরাট কোহলি। তাঁর ব্যাটেই জয়ের রাস্তা সু-মসৃণ হয়েছে ভারতের। ২ রানে নেই ৩ উইকেট। ২০০৪ সালের পর এই প্রথমবারের মতো দুই ওপেনারই ফিরে গিয়েছেন শূন্য রানে।
রোহিত, কিষাণের পর শ্রেয়াস আইয়ারের পাশে যখন সঙ্গী হলো আরেক শূন্য, তখন ভারতের পাশে জড়িয়ে গেছে বিব্রতকর এক রেকর্ড। ভারতের ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথম চারজনের তিন জনই শূন্য রানে আউট হলো এই প্রথম।
এতসব বিব্রতকর রেকর্ডে আটকা ভারতের জন্য জয়ের পথ তখন বহু দূরের পথ। সেই সাথে মিশেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউডের বোলিং তাণ্ডব তো চোখ রাঙানি দিচ্ছিলই। স্বল্প রান তাড়ায় নেমে তাই মোটেই স্বস্তিতে ছিল না ভারত। তবে লোকেশ রাহুলের সাথে জুটি বেঁধে সেই স্বস্তিটা ঠিকই ফিরিয়ে এনেছিলেন বিরাট কোহলি।
শুরুতে অজি বোলারদের সামলাতে বেশ সংগ্রামই করতে হয়েছে কোহলিকে। তবে লক্ষ্য ছিল ছোট। তাই তাড়াহুড়ো না করে ক্রিজে পড়ে থাকাটাই শ্রেয়। বিরাট কোহলি সেই পন্থাই অবলম্বন করেছেন অজিবধের রাস্তা তৈরি করতে। মোক্ষম সময়ে রানের গতিও বাড়িয়েছেন। আর কোহলির সেই ব্যাটিংয়ে ম্যাচ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে থাকে অস্ট্রেলিয়া।
ব্যক্তিগত ১২ রানে পুল করতে গিয়ে যদিও একবার ক্যাচ তুলেছিলেন কোহলি। তবে সেই ক্যাচটা লুফে নিতে পারেননি মিশেল মার্শ। ব্যাট হাতে শূন্য রানের ফেরার পর এমন ক্যাচ মিস আদৌতে ভারতকেই এগিয়ে দিয়েছিল। ঐ শটের পর কোহলি যেন হয়ে ওঠেন আরো সাবধানী। বল সীমানা ছাড়া করার চেয়ে মনোযোগী ছিলেন রানিং বিটউইন দ্য উইকেটে। তাতেই অর্ধ-শতকে পৌঁছে যান কোহলি। আর এখানেই নতুন একটি রেকর্ড গড়েন ভারতীয় এ ব্যাটার।
এ নিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে ১১৩ বার পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেললেন কোহলি। যা ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে নন ওপেনার হিসেবে করা সর্বোচ্চ পঞ্চাশোর্ধ ইনিংসের নতুন রেকর্ড। এর আগে এ রেকর্ড ছিল কুমার সাঙ্গাকারার দখলে। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১১২ বার পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলেছেন লঙ্কান এ বাঁ-হাতি ব্যাটার।
অবশ্য ম্যাচেই শুরুতেই আরেকটি রেকর্ড গড়েছিলেন কোহলি। স্লিপে দাঁড়িয়ে মিশেল মার্শের দুর্দান্ত একটি ক্যাচ নিয়ে তিনি পৌঁছে যান ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ডে। এর আগে যে রেকর্ডটি ছিল অনিল কুম্বলের। বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে এ লেগ স্পিনার ক্যাচ নিয়েছেন ১৪ টা।
ব্যাট হাতে পঞ্চাশ টপকে যাওয়ার পর বিরাট কোহলি ছুটেছিলেন শতকের পথেও। তবে শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। ভারতের জয় যখন হাতের নাগালে, তখনই আউট হন তিনি। হ্যাজলউডের শিকার হয়ে ব্যক্তিগত ৮৫ রানে ফিরে যান তিনি। তবে তাতে ম্যাচ জয়ের পথে আর কোনো ঝড় সূত্রপাত হয়নি। হার্দিক পান্ডিয়াকে নিয়ে বাকিটা পথ সামাল দেন লোকেশ রাহুল। শেষ পর্যন্ত তিনি অপরাজিত থাকেন ৯৭ রানে।
২০১৫ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে এই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই শতক হাঁকিয়েছিলেন কোহলি। তবে দলকে জিতিয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠ ছাড়তে পারেননি। ৮ বছর বাদে, ২০২৩ বিশ্বকাপে এসে এবার বিরাট কোহলি মাঠ ছেড়েছিলেন ম্যাচ জয়ের আগেই। তবে ততক্ষণে ভারতের জয়ের রাস্তাটা তিনি তৈরি করে এসেছেন। তাই এবার আর ম্যাচ হারের আক্ষেপ সঙ্গী হয়নি।
সেঞ্চুরি না পেয়েও বীরের বেশ, স্টেডিয়াম জুড়ে ‘কিং কোহলি’ স্লোগান আর সহস্র করতালিতে সিক্ত হয়ে মাঠ ছেড়েছেন তিনি। কোহলির তৃপ্ততা কিংবা পূর্ণতা এখানেই। সেঞ্চুরির অপূর্ণতা যেখানে মিটে গিয়েছে ম্যাচ জয়ের পূর্ণতায়।