স্যাটেলাইটের যুগে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে দূর্গজয় করা তো আকাশ কুসুম ভাবনা। কিন্ত দূর্গ তো শুধু রণক্ষেত্রে থাকেনা, থাকে ক্রিকেটেও।
সেই দূর্গ ছিলো গ্যাবা। ‘গ্যাবা’ শব্দটা খুব সাধারণ। কিন্তু ‘গ্যাবাইটোর’ শব্দটি শুনলেই মন হয়ে যায় ভীত। টানা ৩২ বছর এখানে টেস্ট হারেনা স্বাগতিকরা। ১৯৮৮ সালে শেষবার কপালে হার জুটেছিল। ভারত কাল যে দল নিয়ে নেমেছিল তার অধিকাংশই তখন পৃথিবীর আলোই দেখেনি। আর সেসব তরুণদের নিয়েই দূর্গজয়ের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন স্থিতধী অধিনায়ক রাহানে।
সিডনি টেস্টের পর যখন বুমরাহ, অশ্বিন, জাদেজাও চোট পেয়ে বেঞ্চে চলে যায় তখন বলতে গেলে শেষ সম্বলটুকুও চলে যায়। গ্যাবাতে ভারত যে দল নিয়ে নেমেছিল তার পাচ বোলারদের মধ্যে দুজন এ ম্যাচে অভিষেক করছেন, দুজন এ সিরিজে অভিষেক করছেন আর একজনের ঝুলিতে শুধু দশটি বল করার অভিজ্ঞতা। নেট বোলার নিয়ে খেলতে নামতে হচ্ছে এর থেকে দুরাবস্থা আর কি হতে পারে।
তবে ভারত নেমেই বোঝাল মাথা কাটা গেলেও ঝুকবে না; ভাংবে কিন্তু মচকাবে না। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব এক সূচাগ্র মেদিনী। প্রথম ওভারেই ওয়ার্নার আউট। ১৭ রানে আরেকটা। অভিষেক এ স্মিথের উইকেট পান সুন্দর। ফিল্ডাররা আরেকটু সাহায্য করলে হয়ত আরো উজ্জ্বল হত। তাও ৩৬৯ এ থামল অজিরা।
কিন্তু জবাবে নেমেই ব্যাটিং বিপর্যয়। ১৮৬/৬।
আউট হয়ে গেছে দলের বড় বড় সব ব্যাটসমান। তখন আছে শুধু গ্যাবার বৃষ্টিস্নিগ্ধ মাঠ, চকচকে নতুন বল, আর তার সম্পূর্ণ ব্যবহার করার জন্য ত্রাস ট্রায়ো আর ঘূর্ণি লায়ন। সে সময় দু ভারতীয় তরুণ বুক চিতিয়ে দাড়িয়েছে, বডিতে বাউন্সার খেয়েছে, তারপরে আবার ফ্রান্টফুটে এসে ড্রাইভ মেরেছে, শর্ট বলকে চ্যালেঞ্জ করে কাট পুল খেলে দেখিয়েছে, দূর্গের দখলদারদের ডেসপারেট করে দেখিয়েছে। যাদের জন্য দল দূর্বল লাগছিল তারাই নিজেদের শক্তি বলে প্রমাণ করল।
সেকেন্ড ইনিংসে ব্যাট করতে নামার পর অজিরা লিড বাড়ানোর প্রচেষ্টাই ব্যস্ত। আচ্ছা অস্ট্রেলিয়ার টেস্টগুলোর সাধারণ দৃশ্য কি? একজন অজি পেসার বাউন্সার দিয়ে ভারতীয় ওপেনার কে আউট করছেন। কিন্তু এ ম্যাচে ঘটনা এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেছে। শার্দুলের শর্ট বল পেয়ে কূলকিনারা না পেয়ে আউট হলেন অজি ওপেনার। এ দল শুধু হৃদয় জিততে নামেনি ট্রফি জিততেও নেমেছে। এরপর আসে সিরাজ।
ক্যারিয়ারের তৃতীয় ম্যাচেই বোলিং লাইনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। রাহানের এক ঘোড়া তিনি। আর সেভাবেই দলকে পিঠে চাপিয়ে টগবগ টগবগ করে দূর্গে ঢুকে পড়লেন দিলেন ক্ষীণ একটা সুযোগ দূর্গজয়ের। ভেংগে দিলেন অজি ব্যাটিং লাইনআপ। পাঁচ পাঁচটা উইকেট। এটাই নতুন ভারত।
গ্যাবায় সর্বোচ্চ রান চেজ হয়েছিল ২৩৬/৮। তাও আবার করেছিল ১৯৬১ সালের উইন্ডিজ। এখানে টার্গেটরা আরো ৯২ রান বেশি। আর দলের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান গুলো দলেও নেই। জেতার কথা তখন কারো মনেই ছিল না। জাস্ট ড্র করে আয়, তাহলেই ট্রফি ঘরে চলে আসবে। ৪র্থ দিনের শেষ সেশন যখন বৃষ্টির জন্য ভেসে গেল তখন বাকি শুধু ৫ম দিন। প্রয়োজন ৩২৪ রান হাতে; ১০ উইকেট। আর বিপক্ষে বাউন্সি ট্র্যাকে ত্রয়ী ত্রাস আর লায়ন ঘূর্ণি।
ভোরবেলাতে উঠে চোখ একটু মলোমলো করে যখন সবাই দেখে যে রোহিত আউটসাইড এজটা দিয়ে দিয়েছে তখন জেতার কথা আর কার মনে আসে! কোনোভাবে ড্র করলেই হয়। মাঠে নামলেন ধৈর্য্যের মূর্ত প্রতীক চেতেশ্বর পুজারা। সবার মনে একটাই কথা, ব্লক পুজারা ব্লক। কোনোভাবে বাকি ওভারগুলো ব্লক করে আয়। আর ওপাশে তরুণ রক্ত টগবগ টগবগ করছে। নাম তার শুভমন গিল। তারুণ্যের জোস নিয়েও নতুন বলকে শ্রদ্ধা দিয়ে খেলছে ছেলেটি। প্যাট কামিন্সের স্পেলটাও ভালভাবেই সামলাল। আস্তে আস্তে রেলগাড়ি আবার ট্র্যাকে ফিরে আসল। যার একপাশে অভিজ্ঞ, স্থিতধী, শান্ততার প্রতীক পুজারা, অন্যদিকে তরুণ রক্ত নিজের তারুণ্যের জোস দেখাতে ব্যস্ত। অজি বোলিং আবার একটু চাপে। লাঞ্চের আগ পর্যন্ত তারা মাটি কামড়ে থেকে গেলেন।
লাঞ্চের কিছুক্ষণ আগ থেকেই অজিরা চিন মিউজিক দিতে শুরু করেছিল। ওয়াকার পর গ্যাবা অস্ট্রেলিয়ার ফাস্টটেস্ট উইকেট। আর সেখানে স্ট্রার্ক-কামিন্স কানের পাশটা গরম করবেনা তা আবার হয় নাকি। কিন্তু শর্ট বলের জন্য ব্যাট সামনে আনার কোনো ইচ্ছাই নেই পুজারার। কামিন্সের একটা বল হেলমেটে, একটা বুকে আরেকটা হাতে। তারপরেও ব্যাট সামনে আনেননি, কেননা এজ দেওয়া যাবেনা মাটি কামড়ে পরে থাকতে হবে। পুজারা এ ভারতীয় দলের সুতা। যার উপর মুক্তার মত বসে আছে বাকিরা। সুতাটা ছিড়ে গেলেই বাকিরা ঝড়ে যাবে। তাই গায়ে বল খেয়েও আফসোস নেই তার। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একেই বোধহয় বীরত্ব বলে।
পুরো দিনে ১০ বার গায়ে বল খেলেন, ৩-৪ বার ফিজিও আসল তাও ব্যাট সামনে আনেননি। মাটি কামড়ে পরে থাকার এক অদ্ভুত প্রচেষ্টা। এ যেন এক মধ্যবিত্ত বাবার দৈনিক সংগ্রাম, যত কষ্ট সব আমার উপরে আসুক, সয়ে নিব কিন্তু পরিবারের বাকিদের মাথার উপর ছাতা হয়ে থাকব। পুজারাও তেমন ছাতা হয়ে থাকলেন গিল পান্তদের মাথার উপর।
আর ওপাশের তরুণটা নিজের খেয়ালেই ব্যস্ত।
এ তরুণ বড়ই ভয়ংকর, ব্যাট আঘাতে ভাংতে চায় পাথর বাধা, এ তরুণ মাথা নোয়বার নয়, এ তরুণ জানেনা কাঁদা।
ব্রিসবেনের ফাস্ট উইকেটে স্ট্রার্ক এর মত বোলারকে থার্ড ম্যান এর উপর দিয়ে আপারকাট করতে জানে এ তরুণ। একই সাথে ফাইন লেগ, ডিপ ফাইন লেগ, ডিপ স্কয়ার লেগ থাকা সত্বেও পুল খেলতে ভয় পায়না এ তরুণ। চিন মিউজিকের সামনে পরপর তিন বলে বাউন্ডারি মারতে জানে এই তরুণ। সকাল আটটা – সাড়ে আটটার দিকে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টিভিতে এসব পুল কাট চোখে পড়লেই চাকরির জন্য লড়াই করেও বারবার চাকরি না পাওয়া ভেংগে পড়া সেই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেটি আবার ভেবে ওঠে আরেকবার মাঠে নামি লড়াই করতে। আরেকবার না হয় তারুণ্যকে সুযোগটা দিয়েই দেখি।
ব্রিসবেনে গিলের এই ইনিংস আর সিডনিতে পান্তের সেই ইনিংস দুটোই জয়ের আশা জাগিয়ে শতরান না পাওয়ার নিরাশায় শেষ হয়। কিন্তু কিছু ৯৭,৯১ যে শতরানের থেকেও বড়। ২০১১ এর গম্ভীর-ধোনি কিংবা ২০২১ এর পান্ত গিল যাদের ব্যাট থেকেই আসুক।
এরপর আসে ম্যাচের নায়ক ঋষভ পান্ত। রাহানের ছোট ক্যামিওটা বুঝিয়েই দিয়েছিল ভারত জেতার জন্য খেলছে। তাই আগারওয়ালের আগে পান্ত এর নামা কোনো সারপ্রাইজ নয়। এ তরুণও নিজের রক্তের গরম দিয়ে বিপক্ষের ঘাম ঝড়াতে জানে, হার্টবিট বাড়িয়ে দিতে জানে। আর গিল-পান্ত যখন রক মিউজিক শোনাচ্ছেন অপরপ্রান্তে শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশনে ব্যস্ত পুজারা। দুই ভিন্ন মনোভাব কিন্তু তিন ইনিংসই জীবনযুদ্ধে পরাজিতদের উঠে দাড়ানোর আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছে।
পুজারার আউটের পর পান্ত আগলে দাড়ালেন এক প্রান্ত। রাউন্ড দ্য উইকেটে আসা লায়নকে লিভ করছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। সুযোগ বুঝে শট ও খেলছেন। ক্যালকুলেটিভ চেজিং যাকে বলে আরকি। পান্তকে এতদিন সবাই জানত জুয়ার কার্ড হিসেবে, হয় মারবে নইলে মাঠ ছাড়বে। কিন্তু এবার তিনি বুঝেসুঝে খেলে দেখালেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের বড়ভাইয়ের মত শেষ পর্যন্ত আগলে রাখল দলকে। সুন্দরকে গাইড ও করল আর শেষ রানটাও করল।
এরপর সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। হেজেলউড এর পিচড আপ বল পান্তের স্ট্রেইট ড্রাইভ আর বাউন্ডারি। এ কি শুধুই বাউন্ডারি? না এ পুরো কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী। ৩৬/৯ থেকে ৩৩৬ আর ৩২৯/৭। ২-১ করার এক বাস্তব কল্পকাহিনী। কে বলেছে খোলা চোখে দেখা স্বপ্ন সত্যি হয়না? আজ পুরো বিশ্ব এরূপ এক স্বপ্ন সত্যি হতে দেখেছে। এ শুধু একটা ম্যাচ বা একটা সিরিজ জয় নয়। এ হলো প্রতিটা মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনিক সংগ্রামের কাহিনি, এ হলে চিন মিউজিকের পালটা জবাবে রক মিউজিক দেখানোর কাহিনি, এ হলো ব্রক্ষ্মাস্ত্র ছাড়া দূর্গজয়ের কাহিনি, এ হলো জীবনশিক্ষা, এ হলো হাজারো তরুণদের নতুন মন্ত্রের দীক্ষা। এ ম্যাচ, এ সিরিজ স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে, স্বপ্ন সত্যি করতে শিখিয়েছে।
আজ থেকে ৫০ বছর পর অন্ধপ্রদেশ বা তামিলনাড়ুর কোনো ছোট এক গ্রামে কোনো এক ঠাকুরদা বা ঠাকুমা রাক্ষসপুরী থেকে রাজকন্যা আনার গল্প না শুনিয়ে এ দূর্গজয়ের গল্প শুনাবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা এ দূর্গজয় তো গল্প হলেও সত্যি।