হারানো দিনের কার্যকর প্যাকেজ

একসময় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে ছিলো তারকাদের মেলা। গ্র‍্যান্ট ফ্লাওয়ার, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, হেনরি ওলোঙ্গা, হিথ স্ট্রিকের মতো তারকারা খেলে গেছেন এই দলটায়। এরপর সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে নিজেদের শক্তিমত্তা হারাতে থাকে আফ্রিকার এই দেশটি।

একসময় বড় দলের বিপক্ষে দাপট দেখানো জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট এখন ধ্বংসপ্রায়। যে জিম্বাবুয়ে দল এখন কোনো দলের কাছে পাত্তা পায় না সেই দলটিই কিনা নব্বইয়ের দশকে বিশ্বক্রিকেটে শক্তিশালী দলগুলোর একটি ছিলো। এই হারিয়ে যাওয়া দলের এক কান্ডারি ছিলেন লেগ স্পিনার পল স্ট্র‍্যাং। নব্বইয়ের দশকে যাকে কিনা সেরা লেগ স্পিনারদের একজন মানা হতো।

শুধু লেগ স্পিনার বললে ভুল হবে। তিনি ছিলেন মূলত একজন লেগস্পিন অলরাউন্ডার। অনিল কুম্বলে, মুশতাক আহমেদের পরে সে সময় স্পিনারদের কথা আসলেই আসতো পল স্ট্র‍্যাংয়ের নাম।

টপ ক্লাস লেগস্পিনার, লোয়ার-মিডল অর্ডারে কার্যকর সব ইনিংস – সব মিলিয়ে তুখোড় অলরাউন্ডার। লেগব্রেক, গুগলি, টপস্পিন কিংবা ফ্লিপার – অস্ত্রশালাটা সমৃদ্ধই ছিল স্ট্র্যাংয়ের। সাথে ক্যারিয়ার যত এগোয় বলের ওপর নিয়ন্ত্রন ততই বাড়ে। আর একই সাথে ছিলেন দুর্দান্ত এক ফিল্ডার। কভার ও ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে নিজের সময়ে তিনি ছিলেন বিশ্ব সেরাদের একজন। সব কিছু মিলিয়ে পল স্ট্র্যাং ছিলেন বেশ কার্যকর এক প্যাকেজ।

২৮ জুলাই, ১৯৭০। বুলাওয়েতে এক ক্রিকেট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পল স্ট্র‍্যাং। বাবা রোনাল্ড স্ট্র‍্যাং ছিলেন একজন টিভি আম্পায়ার। দুই ছেলে পল স্ট্র‍্যাং ও ব্রায়ান স্ট্র‍্যাংকে ক্রিকেটার বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে দুই ছেলেই বাবার স্বপ্ন পূরণ করে সুযোগ পায় জাতীয় দলে।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমের টেস্ট সিরিজে প্রথমবার দলে ডাক পান পল স্ট্র‍্যাঙ। সুযোগ পেয়ে তৃতীয় টেস্টেই শিকার করেন তিন উইকেট। সে সময়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে তিন ভ্রাতৃদ্বয় জুটি খেলতো। গাই হুইটাল-অ্যান্ডি হুইটাল, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার-গ্র‍্যান্ড ফ্লাওয়ারদের সাথে ছিলেন দুই ভাই পল স্ট্র‍্যাং ও ব্রায়ান স্ট্র‍্যাং।

পল স্ট্র‍্যাংয়ের অভিষেকের কিছুদিনের মধ্যে ১৯৯৫ সালে তাঁর ভাই ছোট ভাই ব্রায়ান স্ট্র‍্যাংও জাতীয় দলে জায়গা করে নেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষিক্ত হন ব্রায়ান। পরবর্তীতে দুই স্ট্র‍্যাঙ ভাই মিলে ক্যারিয়ারে ১৪ টেস্ট আর ২৫ ওয়ানডেতে একসাথে জিম্বাবুয়ের জার্সি গায়ে মাঠ মাতান।

১৯৯৬ বিশ্বকাপে দলের পক্ষে বল হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান পল স্ট্র‍্যাঙ। ৬ ম্যাচে ১২ উইকেট শিকার করেন তিনি! যা কিনা ওই টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ। ৪২.১ ওভার বল করে ১৯৩ রান দিয়ে ১২ উইকেট শিকার করেন এই লেগ স্পিনার। তাঁর উপরে ছিলেন ওয়াকার ইউনুস ও অনিল কুম্বলে।

৭ ম্যাচে ১৫ উইকেট শিকার করে শীর্ষে ছিলেন কুম্বলে। এরপর ৬ ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয়তে ছিলেন ওয়াকার ইউনুস। তবে তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্ট্রাইক রেট এবং গড় দুটোই ছিলো স্ট্র‍্যাঙের পক্ষে। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে ওই টুর্নামেন্টে স্ট্র‍্যাঙ সেরা বোলারদের একজন ছিলেন।

কেনিয়ার বিপক্ষে তাঁর পাঁচ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ে ওই টুর্নামেন্টে একমাত্র জয়টি পায়। ম্যাচে দুই ভাই মিলে শিকার করেন সাত উইকেট! পল স্ট্র‍্যাঙের ওই স্পেলকে ওই টুর্নামেন্টের সেরা স্পেলও বলা হয়। সেই পারফরম্যান্স তাকে টেনে নেয় কাউন্টিতে। ১৯৯৭ সালে কাউন্টিতে প্রথমবার কেন্টের হয়ে এবং পরের বছর ন্যটিংহামশায়ারের হয়ে খেলেন স্ট্র‍্যাং।

অক্টোবর ১৯৯৬। ২-০ তে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ হারের মধ্যেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান স্ট্র‍্যাং। প্রথম টেস্টে আগে ব্যাট করতে নেমে ১৪২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে জিম্বাবুয়ে। সেখান থেকে ক্যারিয়ারের মেইডেন টেস্ট সেঞ্চুরি করেন পল স্ট্র‍্যাং।

গ্র‍্যান্ট ফ্লাওয়ারের সাথে ১৩১ রানের জুটি গড়েন তিনি! ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, সাকলাইন মুশতাকদের মতো বোলারদের সামনে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান স্ট্র‍্যাঙ। এরপর নবম উইকেট জুটিতে ছোট ভাই ব্রায়ান স্ট্র‍্যাঙের সাথে যোগ করেন আরো ৮৭ রান! এক সময় ব্যাটিং বিপর্যয়ে ধুঁকতে থাকা দল পল স্ট্র‍্যাংয়ের ১০৬ রানে মোট সংগ্রহ ৩৭৫ রান দাঁড় করে জিম্বাবুয়ে।

পরবর্তীতে বল হাতেও দাপট দেখিয়ে পাঁচ উইকেট শিকার করেন স্ট্র‍্যাং! কিন্তু ওয়াসিম আকরামের ২৫৭ রানের ম্যারাথন ইনিংসে সেই টেস্টে হার নিয়ে মাঠ ছাড়ে জিম্বাবুয়ে। একমাত্র জিম্বাবুইয়ান হিসেবে টেস্টে এক ম্যাচে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকারের কীর্তি গড়ার পরও ম্যাচে হার মানতে হয় পল স্ট্র‍্যাংকে।

এরপর ২০০০ সালের শেষ দিকে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স দেখান তিনি। প্রথম ইনিংসে আট উইকেট শিকার করে নিউজিল্যান্ডকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেন স্ট্র‍্যাং! তবে নিজেদের শক্তিমত্তা জাহির করে কামব্যাক করে কিউইরা।

ম্যাচ জিততে কিউইরা টার্গেট পায় মাত্র ১৩২ রানের। প্রথম ইনিংসে আট উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসে দুই উইকেট শিকার করেন স্ট্র‍্যাং। ম্যাচে ১৫৮ রানে ক্যারিয়ার সেরা ১০ উইকেট শিকার করেন তিনি। এরপর ২০০১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন স্ট্র‍্যাং।

সেটি ছিলো ওয়ানডে। যে ম্যাচে সহজেই বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় পায় জিম্বাবুয়ে। পরবর্তীতে পেশির ইনজুরিতে ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে হয় এই লেগ স্পিনারকে। একই বছর নভেম্বরে ছোট ভাই ব্রায়ান স্ট্র‍্যাংও ক্রিকেটকে বিদায় জানান। তবে বিদায় বললে ভুল হবে। তাকে নিষিদ্ধ করা হয়!

২০০২ সালে রাজনৈতিক কার্যকলাপে দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি জমান ব্রায়ান। সেখানে থেকে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন তিনি। ২০০৩ বিশ্বকাপের সহযোগী দেশ ছিলো জিম্বাবুয়ে। ব্রায়ান স্ট্যাং তখন এক মন্তব্যে বলেন আইসিসির উচিত জিম্বাবুয়েকে বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ হিসেবে না রাখা।

এই মন্তব্যের পর ফুসলে উঠে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট। তবে তখন ছোট ভাইয়ের সমর্থনে এগিয়ে আসেন পল স্ট্র‍্যাং! কিন্তু লাভ হয়নি। প্রায় ৩ বছরের নিষেধাজ্ঞায় পড়েন ব্রায়ান। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে জিম্বাবুয়ে দলে ফিরতে চাইলেও তাকে বিবেচনা করেনি জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট।

২৪ টেস্টে ব্যাট হাতে প্রায় ২৭ গড়ে ৮৩৯ রান করেন পল স্ট্র‍্যাঙ। টেস্টে এক সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেন দুই ফিফটি। ৯৫ ওয়ানডে ম্যাচে করেন ২২ গড়ে ১০৪৭ রান। সর্বোচ্চ ৪৭ রান করেন। বল হাতে টেস্টে শিকার করেন ৭০ উইকেট। ক্যারিয়ার সেরা ১০৯ রানে নেন ৮ উইকেট। পাঁচ উইকেট নেন চারবার। অপরদিকে, ওয়ানডেতে নেন ৯৬ উইকেট, ক্যারিয়ার সেরা ২১ রানে ৫ উইকেট। যার মধ্যে দুইবার শিকার করেন পাঁচ উইকেট।

নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে কোয়ালিটি লেগ স্পিনারদের মধ্যে ছিলেন অনিল কুম্বলে, পল স্ট্র‍্যাং এবং মুশতাক আহমেদ। স্ট্র‍্যাংয়ের বোলিং অ্যাকশন অনেকটা হালের প্রোটিয়া লেগি ইমরান তাহিরের মতোই।

স্ট্র‍্যাঙ একমাত্র লেগ স্পিন অলরাউন্ডার ছিলেন যিনি দলের বিপর্যয়ে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। প্রায় ২৭ গড়ে ব্যাটিং প্রমাণ করে স্ট্র‍্যাঙ সে সময়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এমনকি তাঁর বোলিংয়ের কারণে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে তখন বেশ সমীহ করতো অনেক বড় দলই।

ক্রিকেট থেকে বিদায়ের পর ছোটভাই ব্রায়ান স্ট্র‍্যাং জিম্বাবুয়েতে থেকে গেলেও বড় ভাই পল স্ট্র‍্যাং পাড়ি জমান নিউজিল্যান্ডে। কয়েক বছর কাটানোর পর ২০০৮ সালে সেখানে অকল্যান্ডের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন পল। পরিচিত মুখ হওয়ায় সহজেই হাই পারফরম্যান্স দলের দায়িত্ব পান তিনি।

কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর অধিনে দল এইচআরভি কাপ এবং টি-টোয়েন্টি কাপ জয় পায় দল। এরপর ২০১১ সাল পর্যন্ত স্ট্র‍্যাঙের সাথে চুক্তির মেয়াদ বাড়ায় অকল্যান্ড। তবে চার বছর সেখানে কাটানোর পর তিনি সেখান থেকেও বিদায় নেন।

জিম্বাবুয়ের সর্বকালের সেরা একাদশ গঠন করলে সেখানে ফ্লাওয়ার্স ভাইদ্বয় আর হিথ স্ট্রিকের সাথে নি:সন্দেহে থাকবেন পল স্ট্র‍্যাং। বিশ্বের বড় দলগুলোর সামনে জিম্বাবুয়ে একসময় থ্রেট হয়ে দাড়াতো এই পল স্ট্র‍্যাংয়ের কারণে। স্ট্র‍্যাং পরবর্তী সময়ে জিম্বাবুয়ে আর সেভাবে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়া জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল নি:সন্দেহে মিস করছে একজন পল স্ট্র‍্যাংকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link