সালটা ২০০৫। ইংলিশ ক্রিকেট দল সেসময় র্যাংকিংয়ের নিচের সারিতে অনেকটা পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছিলো। টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো ‘লাফিং স্টক’ নামে।
পরিস্থিতি এতটাই বাজে যে ম্যাচ জেতার আশা করতেও লজ্জা পাচ্ছিলেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা। এরকম টালমাটাল সময়টাতে দলের কাণ্ডারী হয়ে দাঁড়ালেন নতুন এক অধিনায়ক। প্রথাবিরোধী, আত্মবিশ্বাসী আর জয়ের জন্য মরিয়া ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ – নাসের হুসেইন।
একাই হাত ধরে খাদের কিনার থেকে টেনে তুললেন দলকে। তাই এখনো ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়কদের তালিকা করতে গেলে নানান রথী-মহারথীদের নাম ছাপিয়ে নাসেরের নামটাই চলে আসে অনেক ওপরে। বিশেষ কোন প্রতিভার খেল নয় বরং আত্মবিশ্বাস আর পরিশ্রমের ভেলায় ভর করেও যে নিজেকে সেরাদের কাতারে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই দৃষ্টান্তই স্থাপন করে গিয়েছেন নাসের হুসেইন।
ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের তৎকালীন ব্যর্থতার পেছনের কারণ খুঁজতে যাওয়াটা একটু দুষ্কর। প্রতিভা বা চেষ্টা, কোনটারই অভাব ছিলোনা দলে। তবুও কেন যেন সাফল্যের দেখা মিলছিলোনা। টুকটাক দু’একটা ম্যাচ জিতলেও জয়ের ধারা অব্যাহত রাখা যাচ্ছিলোনা। ফলাফল- মিইয়ে পড়ছিলেন ক্রিকেটাররা।
নাসের ঠিক সেই সময়টাতেই হাল ধরেছিলেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস, আপোষহীনতা আর ব্যর্থতা থেকে শেখার অভ্যাস – তিনের সম্মিলিত প্রভাব পড়ছিলো বাকি খেলোয়ারদের ওপর। তাঁর ছায়া পেয়েই যেন আবার ছুটতে শুরু করলো জয়ের ঘোড়া, ফিরে এল ইংলিশ ক্রিকেটের হারানো গৌরব।
দলের বাকিদের সাথে নাসেরের একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য সবসময়ই ছিলো। সবার সাথে মিশে গিয়েও তিনি যেন ছিলেন একটু আলাদা। শিষ্ট ইংরেজ ক্রিকেটারদের বিপরীতে অভিবাসী বাবা সন্তান নাসের ছিলেন প্রচণ্ড রগচটা। চারদিকে শোনা যেত তাঁর রেগে গিয়ে ব্যাট ভেঙে ফেলার গুজব।
ইংল্যান্ড দলে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকের পরও তাঁর মেজাজ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান ছিলেন। চতুর্দিকে যখন তাঁর স্বভাব নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে, তখন তিনি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ হেরে বসলেন। শুরু হয়ে গেলো তাঁকে নিয়ে মিডিয়ার হাস্যরস। কিন্তু তাতে দমে যাননি নাসের।
সেই হারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। যেই রগচটা স্বভাব নিয়ে এত হাসিঠাট্টা, সেই রাগ আর জেদের বশেই টেনে তুলতে শুরু করলেন ক্রমাগত পরাজয়ের সমুদ্রে ডুবতে থাকা দলকে। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে খেলতে থাকা দলের ভাঙা ভাঙা দলের টুকরোগুলোকে জুড়ে দিয়ে নতুনভাবে আকৃতি দিলেন ইংল্যান্ড ক্রিকেটকে।
গড়ে উঠলো নাসেরের ‘সিগনেচার’ ক্রিকেট টিম। যেই প্রতিভাবান আর কৌশলী মানুষগুলো আগে ব্যক্তি ক্রিকেটার হিসেবে খেলতেন, দক্ষ অধিনায়কের নেতৃত্বে তাঁরা এবার খেলা শুরু করলেন দলীয়ভাবে; নিজের জন্য নয় বরং ইংল্যান্ড ক্রিকেটের জন্য, নাসেরের জন্য। নাসের লিখতে শুরু করলেন নতুন এক ইংলিশ জয়যাত্রা।
কিছু ত্রুটি তো নাসেরের ছিলই। কিন্তু প্রতিটি ত্রুটিই ছিলো অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তিনি ছিলেন প্রথাবিরোধী, রগচটা তরুণ, কিন্তু সবকিছুর ওপরে তিনি ছিলেন একজন অন্য ধাঁচের মানুষ। পূর্ববর্তী কোন অধিনায়কের ছাঁচেই তাকে ফেলা যেতোনা। এক ইয়ান বোথামের সাথে কিছুটা মিল ছিলো।
তবুও কোথাও যেন একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছিলো। বোথাম আর নাসের দুজনই প্রথাবিরোধী হলেও অন্যসব খাঁটি ইংরেজদের মতো বোথাম নিজের প্রতিভা নিয়ে আলাদা ধারণা রাখতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিলো প্রতিভার জোরেই জয় ছিনিয়ে আনার। সে প্রভাব সতীর্থদের ওপরও ছিলো।
অনেকটা সময় এ মন্ত্রজোরে কাটিয়ে এলেও ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছিলো বিশ্বক্রিকেটের ধাঁচ। প্রতিভার চেয়ে পরিশ্রম আর কৌশলই বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিলো দিনদিন। এই পরিবর্তনটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি ইংলিশ ক্রিকেটাররা। তাই একটা সময়ে এসে তাদের ভাসতে হয়েছিলো পরাজয়ের জোয়ারে।
নাসের এসেই আমূল বদলে দিয়েছিলেন দলের এই প্রাচীন ধ্যানধারণা। পরিসংখ্যানের মোড় ঘোরাতে এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে লেগ স্পিনার বোলার থেকে নিজেকে পরিণত করলেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যানে।
নিজে তো পরিশ্রমী ছিলেনই, দলের প্রতিটি সদস্যের কাছেও তাঁর একমাত্র চাওয়া ছিলো পরিশ্রম আর সততা। যত বড় খেলোয়াড়ই হোক না কেন, কেউ কোন ভুল করলে অধিনায়ক হিসেবে তিনি সে ভুল শুধরে দিতে ছাড়তেন না।
নাসের নিজের সাহস আর সততার সবচেয়ে বড় পরিচয় দিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ে স্ক্যান্ডালের সময়। দূর্নীতিগ্রস্ত ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড আর আইসিসির বিরুদ্ধে একাই লড়াই করে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তার সাথে রক্ষা করে গিয়েছিলেন দলের বাকিদেরও। তাঁর এই আচরণ প্রমাণ করে দিয়েছিলো, মিডিয়া তাঁকে আপন করে না নিলেও তিনি একজন খাঁটি ইংরেজ।
২০০৫ সালের অ্যাশেজের গল্পটা সবারই জানা। ক্রমাগত হারতে থাকা ইংল্যান্ড সেবার ঘরে ট্রফি নিয়ে ফিরেছিলো। দলের প্রতিটা খেলোয়াড় সেদিন বিজয়ের হাসি হাসলেও সেদিন নিভৃতে বাইশ গজের ইতিহাসে নিজের নামটা খোদাই করে দিয়েছিলেন নাসের হুসেইন। সর্বকালের সেরা না হোক, তিনি খাঁদের কিনারা থেকে ইংল্যান্ডকে টেনে তুলে অন্তত নিজেকে নেতা হিসেবে সেরাদের কাতারে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।