গতির রাজ্যে বাংলাদেশি পেসারদের বেঞ্চমার্ক কত? এই কোনো মতে ১৪০ পার করলেই আলোচনায় আসার বন্দোবস্ত করে ফেলা যায়। তাসকিন, এবাদতরা মাঝে সাঝেই গতির ঝড় তোলেন। তবে সেটা হয় কোনো নির্দিষ্ট ডেলিভারিতে কিংবা ছোট কোনো স্পেলে। কিন্তু ১৪০ কিলোমিটার গতিকে একদম সাধারণ গতি বানিয়ে টানা বল করেছেন এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে। চলমান বিপিএলে এবার এমন অভাবনীয় দৃশ্যের নজির মিলেছে নাহিদ রানার সৌজন্যে।
খুলনা টাইগার্সের হয়ে খেলতে নেমে ২৪ টা বলের মধ্যে ১৭ টা বলই ১৪০+ কিলোমিটার গতিতে করেছেন এই পেসার। প্রতিটা বল দেখে মনে হয়েছে, একদম অনায়েসেই যেন ১৪০/১৪৫ গতিতে বল ছুঁড়ছেন। কোনো কোনো ডেলিভারিতে ছুঁয়েছেন ১৪৮ কিলোমিটার গতিও।
ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে ঢাকা ডমিনেটর্সের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন। কিছুটা স্নায়ুচাপেই ছিলেন বটে। ক্যারিয়ারের প্রথম ডেলিভারিটি তাই হলো অগোছালো, করে বসলেন নো বল। তবে পরের বলটাতেই সোজা স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন নাহিদ রানা। ফ্রি হিট বল হওয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে যান এলেক্স ব্লেক।
তবে নিজেকে এমন বড় মঞ্চে মানিয়ে নেওয়ার জন্য ঐ মুহূর্ত টুকুরই প্রয়োজন ছিল নাহিদ রানার। পরে গতিতে রীতিমত ঝড় তুললেন তিনি। একের পর এক গতিময় বল ছুঁড়ে ভীতি ধরালেন ঢাকার ব্যাটারদের। ম্যাচে ২০ রান দিয়ে একটি পেলেন। তবে ততক্ষণে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন নাহিদ রানা তাঁর গতি দিয়ে।
এবারের বিপিএলে পেসারদের মধ্যে গতির ঝলকানি দেখিয়েছেন পাকিস্তানি পেসাররা। বাংলাদেশিদের মধ্য তাসকিন, মৃত্যুঞ্জয়রা যা একটু দেখিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ অচেনা এক পেসারের এমন বোলিং পেস নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে যাওয়ার মতোই অবস্থা তৈরি হয়। ৬.২ উচ্চতার লিকলিকে গড়নের ছেলেটা কি আসলেই বাংলাদেশি?
হ্যাঁ। দ্বিধায় ফেলে দেওয়া এই নাহিদ রানা একজন বাংলদেশিই। তরুণ এ পেসারের উঠে আসা রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে। সহজাত প্রতিভা বলতে যেমন বুঝায় ঠিক তেমনটায় হয়েছে এই নাহিদ রানার বেলায়। তিন বছর আগেও ক্রিকেট বল নিয়ে বল করার অভ্যাস ছিল না। ২০২০ সালে ক্রিকেট বলে বোলিং করা শুরু করেন। ক্রিকেট বল হাতে নেওয়ার এক বছরের মধ্যেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। আর অভিষেকের প্রথম আসরেই বাজিমাত। ৬ ম্যাচে নেন ৩২ উইকেট। হয়ে যান টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার।
সিংহভাগ ক্রিকেটারদেরই একটা সিঁড়ি বেড়ে আসতে হয়। হয় ক্লাব ক্রিকেট নয়তো বয়সভিত্তিক ক্রিকেট। কিন্তু নাহিদ রানার গল্পে তার কিচ্ছুটি নেই। কখনোই কোনো ক্লাবে খেলেনি। টেপ টেনিস, ফাইভ স্টার বলে পাড়ার ক্রিকেট মাতিয়েছেন। কিন্তু বড় ভাইয়ের কঠিন শর্তের কারণে কখনোই ক্রিকেট বলে বল করা হয়নি। বড় ভাইয়ের কাছে, প্রথমে পড়াশোনা, তারপর অন্যকিছু।
অবশ্য নাহিদ রানা এসএসসি পাশ করার পর তাঁর বড়ভাই কিছুটা নমনীয় হন। ২০২০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে নাহিদ চলে আসেন রাজশাহীতে। আর এসেই রাজশাহীর এক অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়ে গেলেন। পাশাপাশি বিভাগীয় ক্রিকেটারদের নেটে বোলিং করতেন। আর সেখানেই চোখ পড়ে যান তিনি।
রাজশাহীর হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অভিষেক হয় নাহিদ রানার। কোনো ক্লাব কিংবা বয়সভিত্তিক ক্রিকেট না খেলা নাহিদ রানা নিজের প্রথম আসরেই দেখালেন চমক। নিলেন তিনবার ৫ উইকেট। একদম দ্রুত উত্থান যাকে বলে। এর পরের গল্প তো বিপিএলের মঞ্চে। না। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মতো উইকেট পাননি বেশি। কিন্তু বাংলাদেশির যে ব্যাপারটা দেখা মেলে কম সেই গতির সাথে কোনো প্রকার আপস না করে অনায়েসেই বল করে গেলেন তিনি। আলোচনায় উঠে আসতে তাই আর দেরি হয়নি।
নিজের উচ্চতার কারণে সহজাত বাউন্স পান নাহিদ রানা। আর সেটিকেই তিনি অস্ত্র বানিয়ে ব্যাটারদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ান। লাইন লেংথ নিয়ে কাজ করলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে দুর্দান্ত এক পেসার হতে পারেন তিনি। বয়স কেবল মাত্র ২০। এই বয়সেই শুরুটা দারুণ হয়েছে নাহিদের। এখন শুধু নিজেকে ধরে রাখার পালা। কারণ পেসারদের গতির বিপরীতে ইনজুরিও উঁকি দেয় আড়ালে। সে সব কিছুকেই মাথায় রেখে আগামীর পথে সম্মুখপানে এগিয়ে চলতে হবে নাহিদ রানাকে। হয়তো এই নাহিদ রানাই হতে পারেন বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের নতুন ভবিষ্যৎ তারা।