বিশ্বব্যাপী তাঁর খ্যাতি বল হাতে আগুন ঝরানোর জন্য। বল নতুন হোক কিংবা পুরাতন, দুইদিকেই বল সুইং করানোর ক্ষমতা ছিল তাঁর, আর দুধর্ষ সব ইয়র্কারে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প ছত্রখান করে দেয়া ছিল তাঁর সময়ে নিয়মিত দৃশ্য। সতীর্থ ওয়াকার ইউনুসকে সাথে নিয়ে রিভার্স সুইংকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। বল হাতে এতোটাই ভালো ছিলেন যে আড়ালে পড়ে গেছে ব্যাট হাতে তাঁর দারুণ সব ইনিংসের কথা। টেস্টে আট নম্বরে নেমে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড তারই দখলে, করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। বলছিলাম জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়াসিম আকরামের সেই অনবদ্য ২৫৭ রানের ইনিংসের কথা।
সে সময়কার জিম্বাবুয়ে ছিল সমীহ জাগানিয়া এক দল। দারুণ প্রতিভাবান সব তরুণ আর অভিজ্ঞদের মিশেলে গড়া জিম্বাবুয়ের সামর্থ্য ছিল নিজেদের দিনে বিশ্বের যেকোনো দলকে হারিয়ে দেয়ার। সেবার অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের নেতৃত্বে পাকিস্তান মুলূকে টেস্ট সিরিজ খেলতে এসেছিল তাঁরা। প্রথম টেস্টে শেখপুরাতে টস জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয় সফরকারীরা। শুরুতে শহিদ নাজিরের তোপে পড়ে ১৪২ রানে ছয় উইকেট হারালেও পল স্ট্রাং এবং গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারের জোড়া সেঞ্চুরিতে ম্যাচে ফেরে সফরকারীরা। দ্বিতীয় দিনে অল আউট হবার পূর্বে স্কোরবোর্ডে তাঁদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩৭৫ রানের, ৫৩ রানে পাঁচ উইকেট নেন নাজির।
জবাব দিতে নেমে আমির সোহেল এবং সাঈদ আনোয়ার ভালো শুরু এনে দেন স্বাগতিকদের। কিন্তু সেলিম মালিক ৫২ রান করে আউট হলে ব্যাটিংয়ে ধ্বস নামে স্বাগতিকদের। একপর্যায়ে ১৮৩ রান তুলতেই হারিয়ে ফেলে টপ অর্ডারের ছয় উইকেট। পাকিস্তানকে তখন চোখ রাঙাচ্ছে প্রথম ইনিংসেই বড় ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ার। ক্রিজে তখন মইন খান এবং সদ্য আসা ওয়াসিম আকরাম।
ততদিনে আকরামের ব্যাটিং দক্ষতার কথা ভুলে গেছে সবাই। সকলে মুগ্ধ তাঁর বাঁ হাতের বোলিং জাদুতে, ভুলে গেছে ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালে তাঁর বিধবংসী ১৮ বলে ৩৩ রানের ইনিংসের কথা। ব্যাট হাতে তাই রান করতে মুখিয়ে ছিলেন এই পাকিস্তানি তারকা। ক্রিজে এসেই আক্রমণাত্নক ভঙ্গিতে ব্যাট চালাতে শুরু করেন, পাকিস্তান দ্বিতীয় দিন শেষ করে ১৮৯ রান নিয়ে।
তৃতীয় দিনে ধীরে ধীরে নিজেদের জুটি বড় করার দিকে নজর দেন আকরাম এবং মইন। জিম্বাবুয়ের স্পিনারদের বিপক্ষে বেশ স্বাছন্দ্যেই ব্যাট করছিলেন, বারকয়েক পাঠিয়েছিলেন সীমানার বাইরেও। ২৩৭ রানের মাথায় মইনকে অ্যান্ডি হুইটালের ক্যাচে পরিণত করেন পল স্ট্র্যাং। ক্রিজে নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে আসেন সাকলায়েন মুশতাক। মুশতাক যেন সেদিন ক্রিজে টিকে থাকার মিশন নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন , অন্যপাশ থেকে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করছিলেন অধিনায়ক আকরাম।
কোনো কিছুই যেন তাঁকে থামাতে পারছিল না, হুইটালকে লং অনের উপর দিয়ে হাঁকান বিশাল এক ছক্কা। পরবর্তীতে জিম্বাবুয়ের ফিল্ডাররা সব সীমানায় দাঁড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিং করেছেন, মাঠের আয়তনকে কাজে লাগিয়ে এক-দুই রান করে সচল রেখেছেন রানের চাকা। একপর্যায়ে পেয়ে যান তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির দেখা। প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন নয় বছর আগে, ১৯৯০ সালে অ্যাডিলেডে। পাকিস্তান তৃতীয় দিন শেষ করে ৩৯৫ রানে থেকে, আকরাম সারাদিন ব্যাট করা আকরাম অপরাজিত থাকেন ১৪৪ রানের।
চতুর্থ দিন সকালে যেন আরো বিধ্বংসী আকরাম। দারুণ সব শটে জিম্বাবুয়ের স্পিনারদের দিশেহারা করে তোলেন। তাঁরা বুঝতেই পারছিলেন না কোথায় বল ফেললে মুক্তি মিলবে আকরামের রোষানলের হাত থেকে। দারুণ সব সুইপে তিনি চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। অন্যপ্রান্তে মুশতাকও ধীরে ধীরে সামলে নেন নিজেকে, তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি।
অন্যপ্রান্তে আকরামের ছক্কা হাঁকানো যেন থামছিলই না। অষ্টম উইকেট জুটিতে এই দুজন মিলে যোগ করেন ৩১৩ রান যা ছিল সেসময়কার বিশ্বরেকর্ড। পরবর্তীতে স্টুয়ার্ট ব্রড এবং জোনাথন ট্রট মিলে ভাঙেন সেই রেকর্ড। অবশেষে ৭৯ রান করে হুইটালের হাতে কাটা পড়েন মুশতাক, প্রথম বলেই আউট হন ওয়াকারও। শেষ ব্যাটম্যান হিসেবে নাজির যখন শূন্য রানে আউট হচ্ছেন আকরাম তখনো অপরাজিত ২৫৭ রানে। তাঁকে থামানোর সাধ্য সেদিন কারো ছিল না, কে জানে হয়তো অন্যপাশে সঙ্গী পেলে ত্রিপল সেঞ্চুরিই করে ফেলতেন তিনি। ২৩৭ রানে সাত উইকেট হারানো পাকিস্তান পায় ৫৫৩ রানের অনবদ্য এক সংগ্রহ। যদিও ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ড্র হয়েছিল।
আকরাম স্মরণ করেন সেদিনের কথা, ‘ওয়াকার ব্যাট-প্যাড পড়ে দশ ঘন্টা অপেক্ষা করেছে ব্যাটিং এ নামার জন্য। ড্রেসিংরুমে সে রীতিমতো ছটফট করছিল, কিন্তু নেমে প্রথম বলেই আউট হয়ে যায়। সবাই হাসাহাসি করছিল এ নিয়ে, আমি নিজেও। অবশ্যই আমার খারাপ লেগেছিল, তবে আমরা সবাই হাসছিলাম।’
এই ইনিংস দিয়ে ক্রিকেট রেকর্ডবুক উলটেপালটে দেখতে বাধ্য করেন আকরাম। আট নম্বরে নেমে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড তো বটেই, টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ডও তাঁর দখলে। ১২টি ছক্কা হাঁকিয়ে ছাড়িয়ে যায় ইংলিশ কিংবদন্তি ওয়ালি হ্যামন্ডের ১০ ছক্কার রেকর্ড। হয়তো আর কিছুক্ষণ ব্যাট করার সুযোগ পেলে ক্রিকেট ইতিহাসের আরো অনেক রেকর্ডই ভেঙে যেত আকরাম ঝড়ের সামনে।