উৎসবমুখর শোকের মঞ্চ

কালীপূজোর এক সপ্তাহ আগে থেকে আপনি তুবড়ি, রংমশাল ইত্যাদি সব জোগাড় করে রেখেছেন। অনেক খেটেখুটে। কালীপূজোর দিন রাতে আলোয় আলোময় করে তুলবেন আকাশ। কিন্তু দেখলেন সেইদিন এমন বৃষ্টি হলো, যে আপনার সব আয়োজন মাঠে মারা গেলো।

২০১১ সালে জুলাই মাসে শুরু হওয়া লর্ডস টেস্টে ব্যাপারটা খানিকটা এইরকমই হয়েছিল। অবশ্য সেটা শুধু ভারতীয় সমর্থকদের জন্য। ২০০০ তম টেস্ট ম্যাচ, ভারত-ইংল্যান্ডের ১০০ তম টেস্ট ম্যাচ, শচীন টেন্ডুলকারের একশোতম একশোটাও হচ্ছে ধরে নেওয়া যায়। সদ্য বিশ্বজয়ী মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। তাছাড়া শেষ দুটো বিদেশ সফরে হারেনি ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকায় ১-১ ড্র, ওয়েস্ট ইন্ডিজে ১-০ জয়।

এই টেস্ট সিরিজ ও ম্যাচ ঘিরে যে পরিমাণ কাড়ানাকাড়া বেজেছিল, সেরকম তার পরে খুব একটা দেখিনি। ইংল্যান্ডে সিরিজ জয়ের একটা আবছা গন্ধও যেন নাকে আসছিলো। ভারতের রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষ্মণ, জহির খান, মহেন্দ্র সিং ধোনি রয়েছেন। তা খেললেই বা ইংল্যান্ড ঘরের মাঠে। ওই তো কেভিন পিটারসেন আর অ্যালিস্টেয়ার কুক।

বোলিংয়েও ওই জেমস অ্যান্ডারসন আর স্টুয়ার্ট ব্রড যা একটু খেলবে। গ্রায়েম সোয়ান ভারতের সাথে ইংল্যান্ডের পিচে আর কি করবে? অধিনায়ক স্ট্রাউস তো জহিরের এক বলের খদ্দের। আসুক না অস্ট্রেলিয়াতে অ্যাশেজ জিতে, আমরা এদের হারাবোই। চার বছর আগেও হারিয়েছি, আবারো। সেসময়ে ষ্টার স্পোর্টসে একটা বিজ্ঞাপন আসতো। এক সাহেব একজন ভারতীয় কে বলছেন, বিশ্বকাপ জিতলেও আমাদের তো হারাতে পারোনি। ইংল্যান্ডেও পারবে না। ভারতীয় হেঁসে উড়িয়ে দেন। চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস।

কিন্তু সেবার বোধহয় ভারতীয় দলের আত্মবিশ্বাস আত্মতুষ্টিতে পরিণত হয়। এতটাই, যে বিশ্বকাপ শেষ হবার পর ২৮ মে অবধি আইপিএল খেলেই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে সফর। সেখান থেকে ১০ জুলাই খেলা শেষে ইংল্যান্ডে অবতরণ। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় খেলতে যে পরিমাণ প্রস্তুতি লাগে, তার এক শতাংশও সেই সফরের আগে হয়নি।

মাত্র একটা প্রস্তুতি ম্যাচ। আর এরকম পাগলের মতো ক্রিকেট খেললে, আসল সময়ে চোট আঘাত লাগবেই। তাতে কিছুই আশ্চর্য্যের নয়। ইংল্যান্ড সফরের গুরুত্ব ভেবে, এই ধরণের সমস্যার সমাধান বা বিকল্প ব্যবস্থাও তৈরি ছিল না। ফলে যা হবার তাই হলো। বীরেন্দ্র শেবাগ সিরিজ শুরুর আগেই বাইরে। এরপর ভারতীয় বোলিংয়ের দুই স্তম্ভ, জহির খান ও হরভজন সিং, চোট পেলেন।

জহির তো ছিটকে গেলেন সিরিজ থেকেই। একটা গোটা প্রজন্মের শেষের শুরু ওই লর্ডস টেস্ট থেকেই। ২০০২ থেকে ক্রিকেট দেখছি। বহু হার দেখেছি। কিন্তু সবচেয়ে দু:স্বপ্নসম ওই ২০১১-তে ইংল্যান্ড ও ২০১১-১২ তে অস্ট্রেলিয়ায় ৮-০। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সাক্ষ্য দিতে পারি, সেই দুই সিরিজে ভারতের অধিনায়কত্ব খুব খারাপ ছিল।

এটা মেনে নিয়েও, যে কেউই খুব ভালো ফর্মে ছিলেন না, এক দ্রাবিড় ছাড়া, তবুও বলি আমাদের অধিনায়কের কিছু কিছু স্ট্র্যাটেজি খুব দুর্বোধ্য ছিল। নটিংহ্যামে বেলকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত আমি ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন করি না। তবে ততক্ষণে অবশ্য ম্যাচ থেকে ভারতের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। এছাড়া আদ্যন্ত রক্ষণশীল অধিনায়কত্ব। কথায় কথায় একজনকে ডিপ পয়েন্টে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

২০১৪ সালে তুলনামূলক অনভিজ্ঞ আক্রমণ নিয়েও একই লোক অনেক ভালো অধিনায়কত্ব করেছিলেন। সেবার ফিল্ডারদের কল্যানে সিরিজ জলাঞ্জলি যায়। আমার বলতে কোনো বাঁধা নেই যে ২০১১ র ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া সফরের পর ভারতীয় ক্রিকেট বছর দুয়েক পিছিয়ে যায়। বিদেশের টেস্ট হারের ক্ষতে প্রলেপ হিসাবে দেশে ঘূর্ণি পিচ বানানো শুরু হয়। ভালো উইকেটে ভালো দলের বিরুদ্ধে তখন ভারতের টেস্ট জয় অণুবীক্ষন যন্ত্রেও ধরা পরবে কিনা সন্দেহ।

শচীনের একশোতম একশো সেই সিরিজে হয়নি। এক দ্রাবিড় ছাড়া, সবাই ব্যর্থ। ব্যাটিং, বোলিং সবেতে। দীপাবলির আলোর অপেক্ষায় যে সিরিজ শুরু হয় আজকের দিনে, মাস ছয়েকের মধ্যে শেষ হয় স্কান্ডিনেভীয়ান দেশগুলির শৈত্য অন্ধকারে। ইংল্যান্ডে ইমারত টলোমলো, অস্ট্রেলিয়ায় একেবারে ধূলিস্যাৎ।

ঝাড়খণ্ডের ভদ্রলোক তারপরেও যে কিভাবে টেস্ট অধিনায়ক (ওয়ানডে বলছি না কিন্তু) রয়ে গিয়েছিলেন সেটা রহস্য। আদতে রহস্য কি? ওই অমরনাথ না কে যেন – থাক! সেই ধূলোর স্তুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দশ বছরের মধ্যে বিশ্বের সেরা টেস্ট টিম, বহু সমস্যা সত্ত্বেও বিদেশে ধারাবাহিক টক্কর দিতে পারা একটি দল। মন্দ কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link