২০০৩ সালে ইংল্যান্ড বাংলাদেশে পূর্নাঙ্গ সফরে আসে।
সেই সফরের তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে সদ্য বাংলাদেশের হয়ে অনুর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপ খেলা ১৮ বছর বয়সী ডানহাতি ওপেনার ১৪ টা চার ও একটা ছক্কায় ১৬৮ বলে ১১৮ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন। এই ইনিংস খেলার পথে বেদম প্রহার করেছিলেন তিনি ইংলিশ স্পিনার অ্যাশলি জাইলসকে।
ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ডের সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কী করে এমন ইনিংস খেললো এই বালক? কীভাবে সে জাইলকে পড়ে ফেললো?
ছেলেটি স্মিত হেসে বললো, ‘জাইলস তো অর্ডিনারি স্পিনার।’
লোকেরা তখনই খোজ খবর নিতে শুরু করলো, কে এই বালক প্রতিভা? তখন পর্যন্ত সবাই বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের ভাতিজা হিসেবে চিনতো। কিন্তু এই ইনিংসের পর লোকেরা বুঝলো, সে নিজের নামেই বিখ্যাত হওয়ার জন্য এসেছে। নাম তার নাফিস ইকবাল।
ক্রিকেট তাঁর কিছু অবদান তাকে নিজের নামের আলাদা পরিচয় দিলেও বর্তমান ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে তার আরো একটি পরিচয় আছে। তা হলো বর্তমান বাংলাদেশ দলের ওয়ানডে অধিনায়ক ও দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবাল খানের ভাই। তার বাবা ইকবাল খান ও ছিলেন চিটাগাং খেলাধুলার এক খ্যাতিমান ব্যাক্তিত্ব।
শুরুর গল্পটা নিয়ে একটু ধোঁয়াশা আছে। নাফিস নিজে পরে বলেছেন, তিনি ওভাবে জাইলসকে কখনোই ‘অর্ডিনারি’ বলেননি। সে তিনি বলুন আর নাই বলুন, জাইলসের ক্যারিয়ার একরকম শেষ করে দিয়েছিলেন, সেটা সত্যি।
তিনি মুল তোলপাড় টা লাগিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের দারুন বোলিং লাইনআপের বিরুদ্ধে সেই ১১৮ রানের ইনিংস খেলে। সেই দলে ছিলো হগার্ড, হারমিসন এর মতো পেসার আর অ্যাশলে জাইলস, গ্যারেথ ব্যাটি এর মতো স্পিনার। তার ফলস্বরূপ সেই সিরিজে বাংলাদেশের ওয়ানডে দলে তার প্রথম ডাক পড়ে। দলে ডাক পাওয়ার পর উচ্ছাসিত হলেও কিছুটা অবাক ও হয়েছিলেন প্রস্তুতি ম্যাচে এরকম পারফর্ম করার পরও টেস্ট দলে ডাক না পাওয়ায়। ২০০৩ সালে সেই সিরিজেই তার ওয়ানডে অভিষেক হলেও পরের বছর ২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ড এর বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক হয়।
অভিষেক এর পরে ওয়ানডে ও টেস্টে ভালো শুরু করতে না পারলেও ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ওয়ানডে ও টেস্ট পারফর্মেন্স করে। সেই জিম্বাবুয়ে সিরিজ বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনেক সুখকর ও ঐতিহাসিক ছিলো। কারণ সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই বাংলাদেশ তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জিতে।
চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে দুই টেস্টের সিরিজের প্রথম টেস্টের শেষ ইনিংসে এনামুল হক জুনিয়র ম্যাচ জয়ী ৬ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ২২৬ রানে জয় পায়। সেই টেস্টেই নাফিস ইকবাল তার ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি পান। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ৪৮৮ রান করার ক্ষেত্রে ওপেনিং এ নেমে তার ১২২ বলে ৫৬ রানের ইনিংস এই বড় রান করার ভিত গড়ে দেয়।
আবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে শেষ টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে ৩৭৬ তানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৫ উইকেট হারিয়ে ২৮৫ রান করে ড্র করে। সেই টেস্টে সবচেয়ে কম বয়সে ম্যাচে ১২ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড গড়ে আবার এনামুল হক জুনিয়র ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেও সেই টেস্ট ড্রয়ের মূল নায়ক ছিলেন নাফিস ইকবাল। তিনি শেষ দিনের উইকেটেও ৩৬৫ বল টিকে ১২১ রানের দারুন ইনিংস খেলেন।
জাভেদ ওমর বেলিম এর সাথে শত রানের ওপেনিং জুটি করে তিনি প্রায় ২ সেশন ব্যাটিং করেন। এটিকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ম্যাচ বাচানো ইনিংস বলা হয়। এই শতক করার পর নাফিস ইকবাল খান সবচেয়ে কম বয়সী সেঞ্চুরিয়ানদের মধ্যে নাম লেখান যে রেকর্ডে এখন পর্যন্ত তিনি ১৯ নাম্বার এ ( ১৯ বছর ৩৪৯ দিন) । এক নাম্বারে বাংলাদেশের ই আরেক প্লেয়ার, নাফিস ইকবাল খানের সাবেক সতীর্থ মোহাম্মদ আশরাফুল ( ১৭ বছর ৬১ দিন) । এখন হেসে খেলে হারালেও সেই সময় ২ টেস্ট ও ৫ ওয়ানডে খেলতে আসা জিম্বাবুয়ে দলের জয়ের পরিসংখ্যান, অভিজ্ঞতা, মাঠের পারফর্মেন্স সব কিছু মিলিয়েই তারা বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে ছিলো।
কিন্তু সেই টেস্ট ড্র করার পর সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই বাংলাদেশ তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতে। আবার ওয়ানডেতে ০-২ এ পিছিয়ে পড়লেও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ ৩-২ এ বাংলাদেশ জিতে। সেই সিরিজ জয়ে ২ ফিফটি করে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন নাফিস ইকবাল খান।
সেই বছরেই ইংল্যান্ড -অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মোহাম্মদ আশরাফুল এর শতকে কার্ডিফে বাংলাদেশ তাদের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে একমাত্র জয় পান। সেই ঐতিহাসিক জয়ে ও বাংলাদেশ দলের সেরা একাদশে ছিলেন নাফিস ইকবাল খান। এটিই ছিলো ২০ বছর বয়সী ডানহাতি ব্যাটসম্যানের শেষ ওয়ানডে ম্যাচ।
সেই সময়ে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট নাফিস ইকবালকে টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে নিয়মিত খেলানোর কথা চিন্তা করেছিলো। কিন্তু অধারাবাহিক পারফর্মেন্স, অফ ফর্ম এসব কারণে টেস্ট দলে আসা যাওয়ার পর ২০০৬ সালে বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে নাফিস ইকবাল খান নিজের ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন।
২০০৩ – ২০০৬ ছোট এই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নানা কারণেই বড় করতে পারেনি। প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিতি পাওয়া অনেক ক্রিকেটারই এভাবে হারিয়েছে। কিন্তু নাফিস ইকবালের নামটি এক বড় হতাশার নামই। বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে তার মতো অনেক হারানো ক্রিকেটারের নাম থাকলেও তাকে হারানো টা যেন এক দীর্ঘশ্বাস। বিশেষ করে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে।
টেস্ট ক্রিকেটে একটা প্রতিভাবান বোলার নিয়মিত খেলেই তার বোলিং করার বুদ্ধি বাড়ায়। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে একজন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান শুরুতে ভালো রান করতে পারলেও নিয়মিত খেলার মাধ্যমেই সে পরিপক্ব ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠে। নাফিস ইকবাল বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই তার ব্যাটিং প্রতিভায় সবাইকেই মুগ্ধ করলেও টেস্ট ক্রিকেটে তার খেলার ধরণ, পরিপক্কতা, মানসিকতা তাকে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মনে করা হতো।
মারার বলে মেরে এবং ছাড়ার বল ছেড়ে খেলার এক সহজাত প্রবৃত্তি ছিলো তার মধ্যে। এমনকি সেই সময় তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে গোছানো ব্যাটসম্যান মনে করা হতো। টেস্ট মেজাজ, টেকনিক, টেম্পারমেন্ট এই সব মিলিয়ে একজন পূর্নাঙ্গ টেস্ট ব্যাটসম্যান হওয়ার সব কোয়ালিটি তার মধ্যে ছিলো। কিন্তু আফসোস সেই সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট, টিম ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশ ক্রিকেটের কালচার তার মতো প্রতিভাকে নষ্ট করে ফেললো।
সেই সময় বাংলাদেশ ক্রিকেটের কালচারে দলে তরুণদের সুযোগ সহজে হলেও বাদ পড়াটা ছিলো আরো সহজ। আবার এক ফরম্যাটে ভালো খেললেই আরেক ফরম্যাটে সুযোগ দেওয়া হতো। এমনকি এক ফরম্যাটে খারাপ খেললে সব ফরম্যাট থেকেই বাদ দেওয়া হতো। এভাবে অনেক ক্রিকেটার নষ্ট করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট।
তরুণদের প্রতিভার মূল্যায়ন করে দলে সুযোগ দিলেও পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে সেই প্রতিভা বাংলাদেশ ক্রিকেট কখনোই কাজে লাগাতে পারেনি। এমনকি সেই সব ক্রিকেটার পরে ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করলেও কখনো আর দলে সুযোগ পায়নি। নাফিস ইকবাল মাত্র ২১ বছর বয়স থেকে দল থেকে বাদ পড়লেও ঘরোয়া ক্রিকেট পারফর্ম করে ২০০৭ সালেই ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজে তার দলে সুযোগ পাওয়ার কথা ছিলো।
কিন্তু প্র্যাক্টিসের সময় নেটের পিছনে দাড়ানো অবস্থায় চোখে বল লাগায় সে সিরিজ থেকে ছিটকে যায়। এই ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্ভাগা ও বলা যায়। কারণ পরে আর ও নিয়মিত চোটের কারণে দল থেকে বাদ পড়ে যান। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তার ধারাবাহিক পারফর্মেন্স থাকায় তাকে দলে ফেরানোর কথা ছিলো। এমনকি ২০১০ সালে ইংল্যান্ড বাংলাদেশে সফর করতে আসলে নাফিস ইকবালকে বোর্ড থেকেই টেস্ট সিরিজের জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলা হয়। কিন্তু পরে আর দলে সুযোগ পাননি নাফিস ইকবাল।
২০০৫ সালে তার ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জিতলেও তাকে দলে রেখে বাংলাদেশ উইনিং কম্বিনেশন খেলায়নি। তারই দুই ওয়ানডে আগে তিনি ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে ফিফটি পান। কিন্তু টেস্ট ও ওয়ানডের সামগ্রিক ফর্ম বিবেচনায়ই তিনি দল থেকে বাদ পড়েছিলেন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া নাফিস ইকবালের ক্যারিয়ার মাত্র ১১ টেস্ট ও ১৬ ওয়ানডেতে শেষ হয়। তারপর ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০১৭ সালে শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ এবং ২০১৮ সালে শেষ লিস্ট এ ম্যাচ খেলে। এতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানকে ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারলে হয়তো মাত্র ২১ বছর বয়সে ক্যারিয়ার শেষ করতে হতো না এখন প্রায় ৩৬ বছর বয়সেও হয়তো নিজের প্রতিভার যোগ্য প্রমান রাখতে পারতেন।
এরকম প্রতিভা এখনো অনেক হারায় বাংলাদেশ ক্রিকেট, কিন্তু ৪ বছর ক্যারিয়ারেও তিনি দেশের হয়ে অনেক কিছু অর্জন ও করেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক সাফল্যগাথায় অবদান রাখেন যা বর্তমান ক্রিকেট প্রেমীরা সবাই নাফিস ইকবালকে না চিনলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট তাকে চাইলেও ভুলতে পারবে না।