অপেক্ষারত ১৭ বছরের প্রত্যেকটা মুহূর্ত জানে এটা শুধু একটা ম্যাচই ছিল না। এই জয় হতে চলেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য। সেই জয়ে ছিল মাইটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটা জবাব। সাকিব আল হাসানের দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই, আরেকবার সর্বকালের সেরা বলে প্রমাণ করার তাড়না। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ১৮ বছরে পাঁ দিতে চলা একটা ক্রিকেট জাতির মিলিত কণ্ঠস্বর। আমরা আর ছোটটি নেই, হয়েছি তোমাদের মতই বড় এমন কোন বার্তা কিংবা আবার খেলতে আসার নিমন্ত্রণও।
ওভার দ্য উইকেটে এসে বল করা তাইজুলের মিডেল স্ট্যাম্পে পিচ করা বলটা পড়তে পারলেন না হ্যাজলেউড। আম্পায়ার আঙুল তোলার আগেই সাকিব দৌড়ে এসে তাইজুলকে জড়িয়ে ধরলেন। বড় ভাইয়ের মত তাইজুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মুশফিক, মিরাজ, মুস্তাফিজরা ব্যস্ত স্ট্যাম্পগুলো তুলে নিতে। মাঠের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন একেকজন।
ওদিকে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাষ্ট্রীয় কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন মিরপুরে। তামিম, সাকিবরা যখন বাইশ গজে ছুটোছুটি করছেন তখন প্রেসিডন্টে বক্সে পতাকা উড়িয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছেন একজন প্রধানমন্ত্রী। হবেনই তো! টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের কঠিনতম দলটাকে মিরপুরে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
আগের বছর ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ফলে জয়ের একটা টোটকা বাংলাদেশের ছিল। তবে ম্যাচ শুরুর আগে খুব কম মানুষই হয়তো বিশ্বাস করেছে বাংলাদেশ জিতে যাবে। কেননা দলটা মাইটি অস্ট্রেলিয়া। সেবার বাংলাদেশে আসার আগেও দলটি একেবারে পশ্চিমে গিয়ে লম্বা সময় ক্যাম্প করেছিল। ওখানকার আবহাওয়া নাকি অনেকটা বাংলাদেশের মত। এছাড়া ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভেন স্মিথদের সাথে ছিল অল আউট পেস অ্যাটাক।
প্রথম দিনে আগে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৮ রান করেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন সৌম্য সরকার। এরপর ইমরুল, সাব্বিরও ফেরেন রানের খাতা খোলার আগেই। পরপর তিন উইকেট নিয়ে মিরপুরের স্পিনিং ট্র্যাককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন প্যাট কামিন্স। অজিরা বোঝাল ক্রিকেটটা খেলতে জানতে হয়, তাঁদের পেসাররা স্যুইং করাতে পারেন যেকোন জায়গাতেই।
তাতে কী, বাংলার ক্রিকেটের দুই বন্ধু সাকিব-তামিম তখনও ছিলেন। তামিম শুরু ধাক্কা সামলে করলেন ৭১ রান, সাথে সাকিবের ব্যাট থেকে এসেছে পাক্কা ৮৪ রান। এতেই মিরপুরের পিচে ২৬০ রানের লড়াকু পুঁজি পায় বাংলাদেশ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে সত্যিই ভুগেছিল অস্ট্রেলিয়া। একজনও করতে পারেননি হাফ সেঞ্চুরি। ফলে সাকিবের ৫ ও মিরাজের ৩ উইকেটে ২১৭ রানের অল আউট অজিরা।
দ্বিতীয় ইনিংসে আবারো তামিমের ব্যাট থেকে এসেছে ৭৮ রান। ওই ভাঙা পিচে দাঁতে দাঁত চেপে ১৫৫ টা বল খেলেছেন। তামিমও হয়তো স্বীকার করবেন এটি তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস। এছাড়া মুশফিকের ৪১ রানে এবার বাংলাদেশ করলো ২২১। আগের ইনিংসের ৪৩ রানের লিড মিলিয়ে ২৬৫ রানের টার্গেট দেয়া গেল অস্ট্রেলিয়াকে।
অপবাদ ছিল উপমহাদেশের কন্ডিশনে ওয়ার্নারের কার্যকারিতা নিয়ে। ওদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভক্তদের প্রার্থনা ছিল একটিই। ওয়ার্নার তাঁর অপবাদ অন্য কোথাও গিয়ে মিটাক বাপু। তবে ওয়ার্নারও বোধহয় প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলেন। দলের সবচেয়ে কঠিন সময়ে, সবচেয়ে কন্ডিন কন্ডিশনে নিজের কার্যকারিতার প্রমাণ দিলেন। মিরপুর টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে সাকিব-তাইজুল-মিরাজ স্পিন ত্রয়ীর বিরুদ্ধে করলেন ১১২ টা রান। যেই পিচে প্রতিটা রান করতে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছিল।
ফলে চতুর্থ দিন সকালে কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছিল বাংলাদেশের। আবারো এত কাছে এসে ফিরে যেতে হবে। ২৬৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ২ উইকেট হারিয়েই ১৫৮ করে ফেলেছে অজিরা। তবে সাকিবের অন্য এক রূপকথা লিখার পরিকল্পনা ছিল। একই টেস্টে হাফ সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নিয়ে স্যার রিচার্ড হ্যাডলির পাশে বসবেন। এর আগে বাংলাদেশ দলের অন্য ক্রিকেটাররা সাক্ষী দিয়েছেন , ‘সাকিব যেদিন চায় সেদিন যা ইচ্ছা করতে পারে।’ ফলে আমরাও আশায় বুক বেধেছিলাম ‘সাকিব আছেন’।
১১২ রান করা ওয়ার্নারকে ফিরিয়ে সাকিব একটা আভাষ দিলেন। সাকিবকে দেখে তখন বোঝা যাচ্ছিল আজকে সেই যা ইচ্ছে করে ফেলার দিন। মাঠে তাঁর দায়িত্ব নেয়া, আনন্দ, চিৎকার সবকিছুতে শুধু যেন সাকিবময়। এরপরই স্মিথকে কট বিহাইন্ডের ফাঁদে ফেলে পরিষ্কার বার্তা দিলেন আজ জিততেই এসেছেন।
শেষ কাটা হয়ে বেঁধেছিল গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। দ্বিতীয় ইনিংসে সাকিবের ঝুলিতে তখন চার উইকেট, ওই টেস্টে মোট নয় উইকেট। ম্যাক্সওয়েলকে ফিরিয়ে নিজের ১০ উইকেটের কোটা পূরণ করলেন। সেদিন আসলে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডারদের বাঁধাই করা পাতা গুলোও নাড়াচাড়া দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান।
তাইজুলের বলটায় হ্যাজলউড যখন পরাস্ত হয়েছিল তখন সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বান্দরবানের গহীনে বসে সেই ম্যাচের রেডিও ধারভাষ্য শোনা এক যুবকের মধ্যেও। সাকিবময় সেই ইতিহাসে মনে রাখতে হবে তামিম ইকবালের তীব্র লড়াই করা দুটি ইনিংসও।
মনে রাখতে হবে ওভারের পর ওভার বল করে যাওয়া মিরাজ-তাইজুলদেরও। কিংবা বাউন্ডারি লাইন থেকে ছুটে আসা মুস্তাফিজ, নাসির আবার স্লিপে থেকে স্ট্যাম্প তুলতে ছুটে যাওয়া সৌম্যকেই। হয়তো মনে রাখতে হবে সকাল সকাল কলেজ পালিয়ে টেস্ট ম্যাচ দেখতে মিরপুরে ছুটে যাওয়া আমি ও আমার বন্ধুদেরও।