একটি রূপকথার অপমৃত্যু

ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভাল সময় তিনি কাটান নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৯১ সালের ২৫ অক্টোবর আকিব মাত্র ১৯ বছর বয়সে শারজাহতে খেলতে নেমেছিলেন ভারতের বিপক্ষে। সেখানে তিনি মাত্র ৩৭ রান দিয়ে নেন সাত উইকেট। এর মধ্যে ছিল হ্যাটট্রিক। পরপর তিন বলে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলে তিনি সাজঘরে পাঠান রবি শাস্ত্রী, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও শচীন টেন্ডুলকারকে। ২০০০ সাল অবধি এটা ওয়ানডের সেরা বোলিং ফিগার ছিল। পরে রেকর্ডটা ভাঙেন মুত্তিয়া মুরালিধরণ।

লাহোর বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছেন রমিজ রাজা। এক কিশোর এসে দাঁড়ালেন তাঁর পাশে। রমিজ তখন মোটামুটি শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটার। রমিজকে সাধারণ হাই-হ্যালো করলো সেই কিশোর। রমিজের অস্বস্তি বাড়লো, এই বয়সী তরুণরা তো সাধারণত অটোগ্রাফ চায়, কিন্তু এই পিচ্চি তো চাচ্ছে না। মতলবটা কি!

আসলে ঘটনা হল সেই ক্ষুদে পেসারকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং ইমরান খান, দলের সাথে ভারত সফরে যাওয়ার জন্য। রমিজ জানতেন না, এত অল্প বয়সী কেউ তাঁদের সতীর্থ হতে চলেছেন। সেই পিচ্চি ডানহাতি পেসার হলেন আকিব জাভেদ।

১২ বছর বয়সী কোনো শিশুকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে দেখেছেন?

প্রশ্নটা শুনলে নিশ্চয়ই জবাব আসবে, ‘এ তো অসম্ভব!’ তবে, সেই ১৯৮৪ সালে এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিলেন আকিব জাভেদ। তিনি লাহোরের হয়ে শুধু খেলেনইনি, বোলিংয়ের উদ্বোধন করে দ্বিতীয় ইনিংসে দলের হয়ে তিন উইকেটও নেন।

বছর চারেক বাদে তিনি ১৬ বছর ১৮৯ দিন বয়সে প্রথমবারের মত টেস্ট খেলতে নামেন। ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি তৃতীয় সর্ব কনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটার। এর দুই মাস আগেই তাঁর ওয়ানডে অভিষেকও হয়ে যায়।

একজন প্রতিভাবান পেসারের যা যা গুন থাকতে পারে তাঁর সবই ছিল আকিব জাভেদের মধ্যে। তিনি বলকে দু’দিকে সুইং করাতে পারতেন, আর রিভার্স স্যুইং তো পাকিস্তানিদের মজ্জাগত। তবে, সমসাময়িকদের চেয়ে রিভার্স স্যুইংটা তিনি বেশ ভাল করতেন।

ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভাল সময় তিনি কাটান নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৯১ সালের ২৫ অক্টোবর আকিব মাত্র ১৯ বছর বয়সে শারজাহতে খেলতে নেমেছিলেন ভারতের বিপক্ষে। সেখানে তিনি মাত্র ৩৭ রান দিয়ে নেন সাত উইকেট। এর মধ্যে ছিল হ্যাটট্রিক। পরপর তিন বলে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলে তিনি সাজঘরে পাঠান রবি শাস্ত্রী, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও শচীন টেন্ডুলকারকে। ২০০০ সাল অবধি এটা ওয়ানডের সেরা বোলিং ফিগার ছিল। পরে রেকর্ডটা ভাঙেন মুত্তিয়া মুরালিধরণ।

বরাবরই ভারতের বিপক্ষে সফল ছিলেন আকিব জাভেদ। ওয়ানডেতে তিনি ছয় বার ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন। এর মধ্যে চারটাই এসেছে ভারতের বিপক্ষে। ভারতের বিপক্ষে তিনি ২৪.৬৪ গড়ে নেন ৫৪ উইকেট।

১৯৯২ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের আন্ডাররেটেড হিরো ছিলেন আকিব। তিনি সেবার ইমরান খানের নেতৃত্বে ডাউন আন্ডারে ১১ উইকেট পান ২৯.৮১ গড়ে। ইকোনমি ছিল অতিমানবীয় – ৩.৮৬! ফাইনালে তিনি অ্যালেক স্টুয়ার্ট আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকা নিল ফেয়ারব্রাদারকে ফেরান। ১০ ওভারে হজম করেন মাত্র ২৭ রান।

অথচ, সেই বিশ্বকাপের আগে ওয়াকার ইউনুস ইনজুরিতে না পড়লে হয়তো, সেবার দলেই থাকা হত না আকিবের। দলে থাকলেও একাদশে যে জায়গা হত না সেটা নিশ্চিতই। আসলে এটা আকিবের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হাইলাইটস। তিনি ভুল সময়ে জন্মেছেন। একই দলে ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনুস থাকলে, অন্য কোনো পেসারকে সুযোগ দেওয়ার জায়গা কোথায়!

বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে মধ্য নব্বইয়ে ধারাবাহিকতা হারাতে শুরু করেন আকিব। শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ যখন খেলতে নামেন – বয়স তখন মাত্র ২৬। মাত্র ২২ টেস্ট আর ১৬৩ ওয়ানডেতেই থামে তাঁর ক্যারিয়ার। শোয়েব আখতার, আজহার মেহমুদরা চলে আসায় আকিব আর কখনোই ফিরতে পারেননি। তাঁর মত আক্ষেপ পাকিস্তান ক্রিকেটে আর খুব কমই আছে।

পাকিস্তান দলে আকিব জাভেদ সেই সব অন্ধকার সময়ে খেলেছেন, যখন ফিক্সিংয়ের প্রকোপ তীব্র ছিল। ওই সময় প্রায়ই পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠতো। কিন্তু, আকিব জাভেদ কখনোই নিজের ওপর ফিক্সিয়ের ছায়া পড়তে দেননি।

তিনি একবার দাবি করেছিলেন, ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কারণেই ক্যারিয়ার সংক্ষিপ্ত হয় তাঁর। বলেছিলেন, ‘দামি গাড়ি চার লাখ রুপির প্রস্তাব এসেছিল ক্রিকেটারদের কাছে। আমাকেও ম্যাচ ফিক্সিং করতে বলা হয়েছিল। বলেছিল, ফিক্সিংয়ে না জড়ালে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। আমি ফিক্সিংয়ের কথা জানার পর এর বিপক্ষে অবস্থান নেই। প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় আমার ক্যারিয়ার হয়তো ছোট হয়ে গেছে, কিন্তু সে নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমি নিজের মূল্যবোধে ভরসা রেখেছি।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...