আব্দুর রাজ্জাক রাজ। বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে কোনো দৃষ্টিতে একজন কিংবদন্তি বোলার। লম্বা সময় পর্যন্ত একদিনের ক্রিকেটে দেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রায় সব বোলিং রেকর্ড তাঁর দখলে। কিন্তু ক্যারিয়ারের সেরা সময়টাতেই হয়েছেন মারাত্মক অবহেলার শিকার।
সেই রাজ্জাক এখন নিজেই নির্বাচক কমিটির সদস্য হলেন। সেই সাথে শেষ হয়ে গেলো রাজ্জাকের খেলোয়াড়ী জীবন। নিজের এই দুই জীবন নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন খেলা ৭১-এর সাথে। বলেছেন নিজের পরিকল্পনা ও নিজের জীবন নিয়ে।
অভিনন্দন, রাজ। অনেক বড় একটা দায়িত্ব পেলেন।
ধন্যবাদ। হ্যা, অবশ্যই বড় একটা দায়িত্ব। বাংলাদেশ জাতীয় দল গঠনের প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকা নিশ্চয়ই বড় দায়িত্ব।
খবরটা কিভাবে পেলেন এবং পাওয়ার পর প্রথম কী মনে হয়েছে?
আমাকে আকরাম ভাই (ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান আকরাম খান) ফোন করেছিলেন। উনি বললেন, বোর্ড সভায় আমাকে নির্বাচক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমি ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে এই পদের জন্য যোগ্য মনে করায়। আমি সবসময় যে কাজ ভালোবাসি, তাই করতে চেয়েছি। সেদিক থেকে দেখলে এটা আমার জন্য বড় একটা সুযোগ। পছন্দের একটা কাজ হতে যাচ্ছে।
নির্বাচকের কাজটাকে পছন্দের কাজ কেনো মনে করছেন, একটু বুঝিয়ে বলবেন?
দেখুন, আমার কাছে মূল ব্যাপারটা হলো ক্রিকেটের সাথে থাকা। আমি সবসময় আপনাদের সাথেও কথায় বলেছি যে, আমি খেলার পরও ক্রিকেটের সাথে থাকতে চাই। তো সেটার জন্য এভাবে থাকাটা একটা বড় ব্যাপার হতে পারে। আমি এখানে ক্রিকেটারদের কাছেই থাকবো। যেটা বুঝি, সেই ক্রিকেট নিয়েই আলাপ করবো। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া।
সেই সাথে জাতীয় দলের জন্য একটা পাইপলাইন তৈরী করা এবং নতুন খেলোয়াড়দের তুলে আনা; এটারও একটা তৃপ্তি আছে নিশ্চয়ই?
অবশ্যই। তবে এটা তো একটা টিম ওয়ার্ক। আমি সারা জীবন দলের হয়ে খেলতে পছন্দ করেছি। একটা দল হিসেবেই সবসময় পারফরম করা পছন্দ করেছি। সেটাই এখানে করতে চাই। একটা খেলোয়াড় তুলে আনা বড় একটা প্রক্রিয়া। সেখানে অনেক কোচ থাকেন। অন্য নির্বাচকরা থাকেন। আমি এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারলেই খুশী।
রাজ, বোর্ড কী জানিয়েছে, খেলা ছেড়ে দিতে হবে কি না?
না, এখনও কিছু জানায়নি। আমার ধারণা আমার সাথে বোর্ডের অফিশিয়ালি একটা আলাপ হবে। সে সময় ওনারা নিশ্চয়ই টার্মস-কন্ডিশন বলবেন। তবে, আমার মনে হচ্ছে, খেলা ছেড়ে দিতে হবে। েএটাই হওয়া উচিত। নিজে খেলা চালানো অবস্থায় বাকী খেলোয়াড়দের নির্বাচনের কাজ করাটা একটু কেমন যেনো।
মানে, এই নির্বাচক ঘোষণার সাথে সাথে একটা ঐতিহাসিক ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে গেলো!
ঐতিহাসিক কি না, সে তো আপনারা বলবেন। আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে সন্তুষ্ট। এটা এক সময় না একসময় শেষ করতেই হতো। কেউ সঠিক সময়ে শেষ করে, কেউ দেরী করে ফেলে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, সময়টা এখন ঠিক আছে।
আপনি দারুণ ফর্মে আছেন এখনও। সর্বশেষ বিসিএল, এনসিএলেও সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন। এই অবস্থায় খেলাটা ছেড়ে দিতে হওয়াটা আফসোসের না?
আফসোস ঠিক করি না। যেটা বললাম, আমার কাছে এটাকে রাইট টাইমই মনে হচ্ছে। দেখুন শুধু ফর্ম না, ফিটনেসও ভালো আছে আমার। সর্বশেষ টেস্টেও ১১ পার করেছি। তো আমি যদি ভালো অবস্থায় থেকে সরে যেতে পারি, সেটাই সবচেয়ে ভালো না? বোঝা হয়ে আমি কোথাও একদিনও থাকতে চাই না। আমার ফর্ম আছে, ফিটনেস আছে; এটাই বিদায় বলার সেরা সময়।
আপনি যাই বলেন, আপনি আমাদের জন্য কিংবদন্তি। তো আমরা চাইতাম আপনি মাঠ থেকে বিদায় নেন। সেটা তো হলো না।
সবসময় সবকিছু হয় না। সে জন্য রিগ্রেট করে লাভ নেই। আমি জীবনে খুব একটা আফসোস করি না। কারণ, আমি ভাবি, এটাই হওয়ার কথা ছিলো। আসলে এটাই আমার জন্য হয়তো ঠিক করা ছিলো। জীবনের প্রতিটা ব্যাপার তো আসলে নির্ধারিত থাকে। আমার মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার হলে সেটা আমি নিতে পারতাম।
আপনার খেলোয়াড় বাছাইয়ে আদর্শটা কী হবে? সম্ভাবনা, পারফরম্যান্স, প্রতিভা; কোথায় গুরুত্ব দিতে চান?
দেখুন, আমি মনে করি, শুধু প্রতিভা বলে কিছু নেই। আপনি যদি পারফরম করতে পারেন, সেটাই প্রতিভা। মানে প্রতিভার প্রকাশ থাকতে হবে। আমার যখন নির্বাচক কমিটিতে কিছু বলার সুযোগ আসবে, আমি পারফরমারদের পক্ষেই বলবো।
একটু অন্য প্রসঙ্গ। আপনার ক্যারিয়ারের শেষ কয়েকটা বছর প্রচন্ড অবহেলায় কেটেছে। ২০১৪ সালে শেষ খেলার পর মাঝে একটা টেস্ট ছাড়া কিছু খেলার সুযোগ পাননি। অথচ এই সময়েই আপনার সেরা সময় ছিলো। আপনি অবহেলার শিকার হয়েছেন। আর কেউ যাতে এরকম শিকার না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে কী করবেন?
এটা একটু ব্যাখ্যা করে বলি। হয়তো আমার দিক থেকে মনে হয়েছে যে, আমি অবহেলার শিকার হয়েছি। কিন্তু এ নিয়ে আমি অভিযোগ করি না। কারণ, যারা দায়িত্বে থাকেন, তারা তো সেরা দল গঠনের জন্যই কাজ করে গেছেন। সেই বিবেচনায় হয়তো আমি আসিনি। আমি এটা কথা দিতে পারবো না যে, আমার কাজে বা আমার সময়ে আমাদের কমিটির কাজে সবাই খুশি হবেন। আমরা সুন্দর একটা বাংলাদেশ দল গঠনের জন্য কাজ করবো। সে জন্য যা দরকার, তাই করা হবে। তাতে কেউ বাদ পড়বে, কেউ সুযোগ পাবে। কেউ খুশী হবে, কেউ দুঃখ পাবে। কিন্তু আমাদের ওই জায়গাটায় ঠিক থাকতে হবে যে, আমরা সেরা দল গঠনের জন্য কাজ করছি। সেই সেরা দলের ব্যাপারে সবাই একমত হবে, সেটা আমি আশা করি না।
সেরা দল গঠনেই তাহলে আপনার কাজের মূল মন্ত্র?
হ্যা। আর মূল ব্যাপার হল, সততার সাথে নিজের মতটা দেওয়া। যারা এখন কাজ করছেন, আমি বিশ্বাস করি, তারাও এটাই করছেন। আমরা সততার সাথে আমাদের মতটা দিতে চাই। আমরা যা বিশ্বাস করি, যেটা আমাদের সত্যি মনে হচ্ছে, সেটাই বলতে চাই। সেই বলাতে অন্য কেউ ভুল মনে করলেও আমরা পিছিয়ে আসতে চাই না।