আলিম দার; বিশ্বের অন্যতম সেরা আম্পায়ার। তিনি সর্ব্বোচ্চ ১৩২ টেস্টে আম্পায়রিং করেছেন। ক্রিকেটের সব সংস্করণ মিলে ৩৯১ টি ম্যাচ পরিচালনা করার রেকর্ড গড়েছেন।
এতো রেকর্ডের মধ্যেও এই বছরের আগে কখনই নিজ দেশের টেস্ট পরিচালনা করতে পারেননি। ২৬ জানুয়ারিতে প্রথম নিজ দেশের টেস্ট পরিচালনা করার সুযোগ পান। করোনার কারণে আইসিসির নিয়মের কিছুটা পরিবর্তনের কারণে তিনি নিজ দেশের টেস্ট পরিচালনা করতে পেরেছেন। করোনা মহামারির আগে নিরপেক্ষ আম্পায়ার দিয়ে টেস্ট ম্যাচ পরিচালনা করা হত।
আলিম দার পাকিস্তানের হয়ে কখনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেনি। ১৯৮০ এবং ৯০ এর দশকে ১৭ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ এবং ১৮ টি লিস্ট এ ম্যাচ খেলেছেন। ২০০০ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে অভিষেক হয়।
২০০০ সাল থেকে সাদা বলের ক্রিকেটে অনেকবারই আম্পায়ারিং করেছেন। আইসিসির নিয়মের পরিবর্তনের কারণে এইবার প্রথমবারের মত নিজ দেশের টেস্ত পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছেন। আম্পায়ারিং নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে।
আপনি কি সীমিত ওভারের ক্রিকেটের থেকে ভিন্ন ভাবে টেস্টের জন্য প্রস্তুত হন?
টি-টোয়েন্টি একটি দ্রুত খেলা এবং এর জন্য ভিন্ন ধরনের মনযোগের প্রয়োজন। টেস্ট ম্যাচ পরিচালনা করার জন্য ভিন্ন ধরনের স্বভাবের প্রয়োজন। আম্পায়ার হিসেবে আপনি টেস্টকে পাঁচ দিন বা চার দিনের ম্যাচ হিসেবে বিবেচনা করতে পারবেন না। পাঁচ দিনের খেলা হিসেবে বিবেচনা করলে আপনি মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়তে পারেন। তাই আপনাকে সেশনের বাই সেশন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যদি এইভাবে বিবেচনা না করেন তাহলে আপনি মনযোগ হারাতে পারেন। এটা খুব কঠিন একটি কাজ। চাপ সহ্য করার জন পর্যাপ্ত মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। আম্পায়ারিং করার জন্য আপনাকে শারিরীক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। ম্যাচের প্রতি আপনার দৃঢ় দৃষ্টি রাখতে হবে। আর আম্পায়রিং করার জন্য এটিই প্রাথমিক যোগ্যতা।
আপনার ম্যাচের আগের কোনো রুটিন আছে যেটা আপনি নিয়মিত অনুসরণ করেন?
আমরা সাধারণত নেটে যাই এবং ক্রিকেটারদের পর্যবেক্ষণ করি। আমি নেটে গিয়ে ব্যাটসম্যানদের খুঁজি। তাদের ব্যাটিং এর ধরণ, টেকনিক পর্যবেক্ষণ করি। তারা কিভাবে পরিবর্তিত হয় সেটাও লক্ষ্য করি। এটা আমাকে ম্যাচে আমাকে সাহায্য করে। যেমন, ফাওয়াদ আলমের ব্যাটিং স্টান্স এবং টেকনিক ভিন্ন ধরনের। আমি তাকে নেটে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। এটা আমার জন্য একধরনের অনুশীলন। বোলারদের ক্ষেত্রেও একই কাজ করি। আর এভাবেই আমরা আম্পায়াররা ম্যাচের আগে প্রস্তুত হই।
প্রযুক্তির মাধ্যমে যখন সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় তখন কি খারাপ লাগে?
প্রযুক্তি সত্যিই কার্যকর। বিশেষ করে সন্দেহজনক ক্যাচ এবং এলবিডব্লু এর জন্য। আমার মনে হয় ক্রিকেটার চেয়ে আম্পায়ারদের বেশি চাপের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ তাদেরকে পারফর্ম করতে হয়। আমি একজন আম্পায়ার হিসেবে নিজেকে অনুভব করি। যখন ভুল করি তখন নিজেও পরীক্ষিত হতে পারি। টেস্টে মাঝে মাঝে প্রথম দুই ওভারের মধ্যে ভুল করবেন সেটা আপনাকে চাপের মধ্যে ফেলে দেবে। কিন্তু আপনি ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে পালাতে পারবেন না। তবে আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে আপনার হতাশার অনুভূতি কাজ করবে। সুতরাং, প্রযুক্তি আম্পায়ারিং এ উন্নতিতে কাজ করে। আর এটা ভালো একটি সহযোগিতা।
আর আপনি চাইবেন না একটি সিদ্ধান্ত খেলার বাকি অংশে প্রভাব পড়ুক। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে প্রযুক্তি আপনাকে সহায়তা করবে। আম্পায়ার হিসেবে ভুল হতেই পারে। ভালো আম্পায়ার হিসেবে আপনি চাইবেন উন্নতি করতে এবং ভুলের পরিমান কমিয়ে আনতে। আপনি আগের একটি ভুলকে অন্য নিজের সমস্যার কথা বলে অন্যকে ভাবার সুযোগ দিতে চাবেন না। আপনি তখনই টিকে থাকবেন যখন মানসিকভাবে শক্ত থাকবেন। আর ম্যাচ কি রকম ভাবে পরিচালনা করবেন সেটার উপর নির্ভর করবে। আর সেখানেই আপনাকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করে ম্যাচের বাকি অংশ পরিচালনা করতে হবে।
আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে কোনটি আপনার প্রিয় ম্যাচ?
আমি সৌভাগ্যবান আমি ৩৯১ টি ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছি। কিন্তু একটি ম্যাচ আমি কখনই ভুলতে পারবো না। ২০০৪ সালে ক্যান্ডিতে অনুষ্ঠিত শ্রীলংকা এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচ। এটা আমার জন্য একটা বড় সাফল্য। এই ম্যাচ আমার ক্যারিয়ারকে বদলে দিয়েছে। এই ম্যাচের পর আইসিসি আমাকে জানায় আমি আইসিসির এলিট প্যানেলের আম্পায়ার হবো। এই ম্যাচে প্রায় ৫৯ টি আবেদন করা হয়েছিলো। তরুণ বয়সে এতগুলো আবেদনের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়া খুব কঠিন ছিলো। কিন্তু আমি ৯৯ শতাংশ সিদ্ধান্ত সঠিক দিয়েছিলাম। একটি মাত্র সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো। বলটি অনেক বেশি টার্ণ করেছিলো। আর যখন মুরালিধরন বল করে তখন আম্পায়ার হিসেবে থাকা খুব একটা কঠিন ব্যাপার। এটা শুধু আমার জন্য না। সব আম্পায়ারের জন্য। টার্নিং পিচে আম্পায়ারদের আসল পরীক্ষা হয়।
আরেকটা ম্যাচ আমার স্মরণ করতে ভালো লাগে।জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ওয়ানডে ম্যাচ। ওই ম্যাচে সর্ব্বোচ্চ রান তাড়া করে দক্ষিণ আফ্রিকা দল জিতে গিয়েছিলো। এই দুইটা ম্যাচ আমার জন্য বেশি স্মরণীয়।
পাকিস্তানে আম্পায়ার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার সঠিক পথ কী? আর যারা আম্পায়ার হতে চায় তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
আমি পিসিবিকে ক্রমাগত অনুরোধ করছি যাতে তাঁরা ক্রিকেটারদেরকে আম্পায়ারিং পেশায় আসতে উৎসাহিত করে। এটা সত্য না যে একজন ভালো ক্রিকেটার একজন ভালো আম্পায়ার হবে। তবে হ্যাঁ, এটা সুবিধা যে এলিট প্যানেলের বেশিরভাগ আম্পায়ার সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার। তবে আমি বিশ্বাস করি যেকোনো পর্যায়ের ক্রিকেটারই এখানে ভালো করবে। তাঁরা এখানে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। আর তার ক্রিকেটারদের মানসিকতা বুঝতে পারবে। তাদের এগিয়ে আসা উচিত এবং এই মহান পেশাটা গ্রহণ করা উচিত।
কিন্তু আমার মনে পাকিস্তানে এটা খুব বেশি আকর্ষনীয় নয়। কারণ অর্থ যতটুকু আকর্ষনীয় হবার কথা ঠিক ততটূকু আকর্ষনীয় নয়। এখন আসলেই পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের উচিত এই পেশাকে আরো গুরুত্বপুর্ণ করে তোল এবং ভালো পরিমান অর্থের ব্যবস্থা করা।
যখন কেউ কোনো পেশায় আসতে চায় তখন সবাই ভালোভাবে জীবন ধারণ করতে চায়। যখন কোনো পেশাতে টাকা থাকবে না তখন রাস্তা তা বন্ধ হয়ে যাবে। কারন ক্রিকেটাররা এই পেশাকে সময়ের অপচয় হিসেবে ভাবে এবং উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এখন আমাদের কাছে অনেক সুযোগ আছে। পাকিস্তান সুপার লিগ আছে, ঘরোয়া শীর্ষ লিগ আছে। কিন্তু অন্যান্য পর্যায়ের আম্পায়াররা অর্থের অভাবে ঝড়ে পড়ছে।