বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটি পাপুয়া নিউ গিনির ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ম্যাচ ছিল।
২০১৮ ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেছিল, আন্তর্জাতিক ম্যাচই ছিল সেটি। তবে বিশ্ব আসরে তারা প্রথম খেলছে এবারই। সেখানে প্রথমবার খেলবে কোনো টেস্ট দলের সঙ্গে। খেলা টিভিতে দেখাবে তাদের দেশে, বিশ্বজুড়ে কোটি দর্শক দেখবে। দলের লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডার ও সহ-অধিনায়ক চার্লস জর্ডান আমিনি গতকাল বললেনও, ‘সম্ভবত আমাদের সবচেয়ে বড় ম্যাচ, বড় সুযোগ।’
গতকাল চার্লস আমিনির প্রেস কনফারেন্স দেখে মনে পড়ল পরশ খড়কাকে। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে প্রেস কনফারেন্সে পরশের পারফরম্যান্সে চমকে গিয়েছিলাম। বিশ্বমঞ্চে প্রথমবার খেলতে আসা আনকোরা দলের অধিনায়ক এত স্মার্ট কথা বলেছিলেন, ক্রিকেট ভাবনা, দর্শন আর জানার গভীরতায় চমকে গিয়েছিলাম। কাল আমিনির প্রেস কনফারেন্সেও আমরা উপস্থিত গুটিকয় মুগ্ধ হলাম। তার কথা বলা, স্বতস্ফূর্ততা, নিজের ও পিএনজির ক্রিকেট নিয়ে তার উপস্থাপনায়।
পিএনজির ক্রিকেট নিয়ে বলতে গেলেই অবশ্য আমিনির ও আমিনিদের কথা বলতে হবে সবার আগে।
আমিনি পরিবারের কথা আমাদের ক্রিকেট অনুসারীদের অনেকেই জানেন এখন। যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি, চার্লস আমিনির দুই ভাই ক্রিকেটার, তাদের বাবা-মা, ফুপু, দাদা এবং পরদাদা, সবাই ছিলেন ক্রিকেটার।
রাজধানী পোর্ট মোরসবিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠের নাম ‘আমিনি পার্ক’। বলার অপেক্ষা রাখে না, কোন পরিবারের অবদানকে সম্মান জানিয়ে এই নামকরণ।
তাদের পরিবারের ক্রিকেট সংযোগ গত শতাব্দির শুরুর দিকে। চার্লসের পরদাদা আমিনি ক্রিকেট দল গঠন করে নৌকায় রাজধানী পোর্ট মোরসবিতে গিয়ে শহরের বিভিন্ন দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলতেন।
তার হাত ধরেই এই পরিবারের ক্রিকেট চলতে থাকে বংশ পরম্পরায়। আমিনির ছেলে ব্রায়ান আমিনি স্কুলে পড়াশোনা করেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর বন্ধন পোক্ত হয়। ক্রমে তিনি নিজেকে তুলে নেন জাতীয় পর্যায়ে। যে সময়টায় সেখানে শুধু ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা প্রবাসীরাই ক্রিকেট খেলতেন, ব্রায়ান ওই সময়টাতেই পিএনজির প্রথম স্থানীয় অধিনায়ক হয়ে ইতিহাস গড়েন।
১৯৭৫ সালে সফরকারী ফিজির বিপক্ষে পিএনজিকে নেতৃত্ব দেন ব্রায়ান। এমনকি ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ হয় তাঁর।
খেলা ছাড়ার পর ব্রায়ান কাজ শুরু করেন ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে। পিএনজির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন তিনি আগে থেকেই। নিউজিল্যান্ডে পাপুয়া নিউ গিনির হাই কমিশনার হন তিনি।
সেখানে ক্রিকেটের প্রেমে মজে যায় ব্রায়ানের ছেলে চার্লস আমিনি। পোর্ট মোরসবিতে বাড়ির আঙিনায় খেলে মনের খোরাক মেটাত ছোট্ট চার্লস। নিউ জিল্যান্ডে গিয়ে প্রথমবার টার্ফ উইকেটের স্বাদ পেয়ে আরও পোক্ত হয় তাঁর ক্রিকেট প্রেম।
পরে দেশে ফিরে খেলা চালিয়ে যান চার্লস। সুযোগ পান জাতীয় দলে। এক সময় অধিনায়কত্বও পান। ক্রমে হয়ে ওঠেন পিএনজির ক্রিকেটের কিংবদন্তি। আশি ও নব্বইয়ের দশকে লম্বা সময় নেতৃত্ব দেন দলকে। ১৯৮৬ আইসিসি ট্রফি থেকে শুরু করে ১৯৯৭ পর্যন্ত প্রতিটি আইসিসি ট্রফিতে খেলেন তিনি।
চার্লসের বোন শেরিল আমিনিও ছিলেন ক্রিকেটার। পাপুয়া নিউ গিনির মেয়েদের জাতীয় দল বিদেশি দলের বিপক্ষে যখন প্রথম ম্যাচ খেলে, জাপানের বিপক্ষে সেই ম্যাচে খেলেন শেরিল। পরে জাতীয় দলের মিডিয়া ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ক্রিকেটের পথচলায়ই চার্লসের পরিচয় কুনের সঙ্গে। পরিচয় থেকে পরিণয়। সেই কুনে আমিনি পরে নেতৃত্ব দেন পিএনজির মেয়েদের জাতীয় দলকে।
এই চার্লস ও কুনে দম্পতির তিন ছেলে। একসময় চার্লস কাজ করতেন মেলবোর্নে। পারিবারিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি মেলবোর্নের ক্রিকেটীয় আবহেও খেলাটির জগতে ঢুকে পড়ে তিন ছেলেই।
বড় ছেলে ক্রিস্টোফার আমিনি পেস বোলিং অলরাউন্ডার। পিএনজির প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২০১৪ সালে দেশকে নেতৃত্ব দেন ক্রিস্টোফার। মেজো ছেলে কলিন আমিনি ছিলেন অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে পিএনজির অধিনায়ক। আর ছোট ছেলে চার্লস আমিনি জুনিয়র।
সমৃদ্ধ এই ক্রিকেট পরিবারের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি এই চার্লস আমিনি। অনূর্ধ্ব-১৫ পর্যায় থেকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন তিনি। ২০০৮ ও ২০১০ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে খেলেন দেশের হয়ে। সেই পথে ধরে এক সময় পা রাখেন জাতীয় দলে। এখনও পর্যন্ত খেলেছেন ২১ ওয়ানডে ও ২৭ টি-টোয়েন্টি। আইসিসির ডিভিশন ক্রিকেট লিগগুলোয় খেলেন নিয়মিতই। গত তিন বছর ধরে জাতীয় দলের সহ-অধিনায়ক তিনি। ২০১৩-১৪ মৌসুমে বিগ ব্যাশে রুকি চুক্তিতে ছিলেন সিডনি সিক্সার্সে।
বাবার মতো চার্লস আমিনিও দারুণ আগ্রাসী ক্রিকেটার।
বাবা যখন আইসিসি ট্রফি খেলতেন, বাংলাদেশও তখন নিয়মিত খেলত। মুখোমুখি দেখা হয়নি যদিও। তবে বাবার কাছ থেকে সেই সময়ের অনেক গল্প শোনেন বলেই তিনি জানালেন। তাঁর স্বপ্ন, বাংলাদেশের মতোই নানা ধাপ পেরিয়ে এখন পিএনজি টেস্ট ক্রিকেট খেলবে।
মাসকাটে গত কয়েকদিন পিএনজি দল ও তাদের সমর্থকদের দেখে ক্যারিবিয়ান ফ্লেভার পেয়েছি। তাদের জার্সি যেমন রঙচঙে, ক্যাপ ভিন্নরকম ও নান্দনিক, তেমনি তাদের দর্শনও রঙিন বলে মনে হয়েছে। প্র্যাকটিসে হাসি-মজা করছে, গুটিকয় সমর্থক ঢোল, ব্যান্ড বাজিয়ে মাতিয়ে রাখছে।
আজ বাংলাদেশের বিপক্ষে লড়াই, পিএনজির জয় কামনা তাই করতে পারিনি। ওমান জিততেও পারেনি সাকিব-রিয়াদদের কাছে। তবে পিএনজির ক্রিকেটের জয় চাইব সামনের পথচলায়।
– ফেসবুক থেকে