শারজার ক্রিকেট-উদ্যানে বসেছিল এশিয়া কাপের পঞ্চম আসর। ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে, বাংলাদেশের সাংবাদিক উৎপল শুভ্রকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য ধারাভাষ্য কক্ষে এসে যেন বসেন। তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের নাম-পরিচয় জেনে নিতে পারবেন, ধারা বর্ণনার দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ ক্রিকেট তখনও হামাগুড়ি দেয়ার পর্যায়ে, মিডিয়াও পৌছায়নি আজকের অবস্থায়, তাই ভিনদেশিদের বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের চেনার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু, উৎপল শুভ্রকে অবাক করে দিয়ে এক ব্যাটসম্যানকে দেখিয়ে হার্শা বলে উঠলেন, ‘ওর নাম বলতে হবে না। ওকে আমি চিনি। ওর নাম আমিনুল ইসলাম। তোমাদের সেরা ব্যাটসম্যান।’
আমিনুল ইসলামকে তখন পর্যন্ত হয়তো একটি কি দুটি ম্যাচে দেখেছিলেন হার্শা, স্মৃতিশক্তির প্রখরতায় তাতে হয়তো নাম বলে দেয়া যায়। তাই বলে ‘সেরা ব্যাটসম্যান’ বললেন কিভাবে? এখানেই আমিনুলের সাথে আর পাঁচজনের পার্থক্য। সেরা ফর্মের আমিনুলের মিনিট-পনেরোর ব্যাটিং-ই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে, এ কোনো সাধারণ ব্যাটসম্যান নয়। তাঁর ব্যাটিং এমনই মুগ্ধ করে ছাড়ে যে, মুগ্ধতার রেশ কাটে না হার্শা ভোগলের মতো ক্রিকেট পন্ডিতদেরও।
এমন প্রতিভাধর প্রজাতির ব্যাটসম্যান হওয়া সত্ত্বেও, দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্টে তাঁর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ছিল সংশয়। বছর কয়েক ধরে যে রানে ছিলেন না। ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করতেই যেন উঠেছিল তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নও। যদিও পরে অমুছনীয় এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন। এবং সেই প্রত্যাবর্তনের পালায় পুরো বিশ্বকেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ব্যাটসম্যানশিপের নিদারুণ মহিমা।
সেই মহিমা এমনই ছিল যে, ইয়ান চ্যাপেলের মতো মানুষেরা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘দেখে তো মনে হয় ছেলেটা পঞ্চাশতম টেস্ট খেলতে নেমেছে।’
দুঃসময় কার না আসে? তবে তাঁর দূর্ভাগ্যই বলতে হবে, তাঁর দুঃসময়টা বড় অসময়ে এসেছিল। ক্যারিয়ারের দুরন্ত ফর্মে যখন ছিলেন, সে সময়ে বাংলাদেশ খেলেছিল কেবল সাতটি ওয়ানডে। তাও আবার প্রথম তিন বছরে, পরের চার বছর কোন ম্যাচই খেলতে পারেননি।
১৯৯৯ সালে স্বদেশের প্রথম বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন নেতৃত্বভার কাঁধে নিয়ে। সেই নেতৃত্ব গেল, ফর্ম গেল, দলে তাঁর জায়গাটারও যায় যায় অবস্থা হয়ে গেল।
প্রবল দুঃসময়ে, অস্তিত্বের সংকটে শরণাপন্ন হয়েছিলেন, তখনকার শ্রীলঙ্কা দলের কোচ ডেভ হোয়াইটমোরের। অভিষেক টেস্টের আগে, ডেভ তাকে দিয়েছিলেন কুড়ি মিনিটের টোঁটকা। রান, সময় দেখার দরকার নেই। কেবল কুড়ি মিনিট করে ভাববে। কুড়ি মিনিট ফুরিয়ে গেলে, আবার নতুন করে শুরু করবে। এভাবে করতে করতে কবে যে ৫৩৫ মিনিট উইকেটে কাটিয়ে দিলেন, ৩৮০টি বল খেলে ফেললেন, আর ১৪৫ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংসের মালিক হয়ে গেলেন, যেন বুঝতেই পারেননি! কেমন এক ঘোরের আবর্তেই যেন সব হয়ে গেল।
সেই একটা ঘোরেই তাঁর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় ঘোরের জন্ম দিতে পারেননি। বড় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘যখনই বুঝতে শিখেছি, টেস্ট ক্রিকেটটা কিভাবে খেলতে হয় তখনই আমাকে ছুঁড়ে ফেলা হলো। আর কিছুদিন খেলতে পারলে হয়তো বাংলাদেশ ক্রিকেটকে আরেকটু ভালো জায়গায় পৌছে দিতে পারতাম।’
চেয়েছিলেন অন্তত ২৫টি টেস্ট খেলবেন। খেলতে পেরেছিলেন কেবল ১৩টি টেস্ট!
ক্রিকেটার না হয়ে তিনি বড় করতে পারতেন ফুটবল ক্যারিয়ারটাও। ছেলেবেলায় সমানতালে দুটোই খেলতেন। সকালে ক্রিকেট, বিকেলে ফুটবল। শফিকুল ইসলাম মানিকের সাথে ওয়ান টু ওয়ান ট্যাকলে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার চিরতরে শেষ হয়ে গেলে, শুরু হয় পরিপূর্ণ ক্রিকেটার হওয়ার এক নতুন গল্প। নির্মাণ স্কুল থেকে শুরু হয়ে যা পরিপূর্ণতা পায় আইসিসি ‘ইয়াং ক্রিকেটার্স স্কোয়াড’ এ জায়গা করে নিয়ে। সেবার ব্রায়ান লারার উইকেট সহ এক ম্যাচে পেয়েছিলেন ছয় উইকেট। বোলার হিসেবে শুরু করলেও, পরে ব্যাটিংয়েই অধিক মনোযোগী হন।
ভাগ্যিস, ব্যাটিংয়ে মনযোগী হয়েছিলেন, নইলে ‘ঐতিহাসিক ১৪৫’ কোথায় রয়ে যেত!
তাই বা বলি কিভাবে? আমিনুল ইসলাম যে কাজটি করতেন তাতেই তো শিখর ছুঁতে চাইতেন। বোলিংয়ে অধিক মনোযোগ দিলে হয়তো সেখানেই জন্ম দিতেন কোনো ঐতিহাসিক কীর্তি-গাঁথা।
পড়াশোনায় বেশিদূর এগোতে পারেননি বলে থেমে থাকেননি কখনোই। বরং তিনি সবসময় কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন তাঁর সমসাময়িক বন্ধুদের চেয়ে। জেমি সিডন্স, ডেভ হোয়াইটমোরের মতো ক্রিকেট পণ্ডিতদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই ১৯৮৮-১৯৮৯তেই। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন, নিজ খরচেই। শেখার আগ্রহ, নিজেকে আরো নিঁখুত, আরো ক্ষুরধার, আরো উঁচুতে তুলে নেয়ার অভিপ্রায় তাঁর জন্মগত।
চীনা বিজ্ঞানীদের পেছন পেছন তিনি ক্লান্তিহীন ঘুরে বেড়িয়েছেন বায়োমেকানিকসে জ্ঞান আহরণ করবেন বলে! সাধে কি আর তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠতম মস্তিষ্কের অধিকারী বলে!
‘ওশিমুং ঝালা পানচিও জাওলিয়ান। ওয়াচিও চুংওয়া সাম্মা তায়া পানচিও।’ – ‘আমি একজন ক্রিকেট কোচ, এসেছি বাংলাদেশ থেকে। আমি তোমাদের চাইনিজদের শেখাবো কিভাবে ক্রিকেট খেলতে হয়।’
চীনের স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছুটে বেড়ান তিনি, সাংহাই-বেইজিংয়ের রাজপথে হেঁটে বেড়ান ব্যাট-বল হাতে নিয়ে। কিশোরদের কাছে ক্রিকেটটা তুলে ধরেন। তাদের অনুপ্রাণিত করেন যেন তাঁরা ক্রিকেট খেলে, ক্রিকেট শেখে।
শুধু চীন নয়, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া সর্বত্রই তিনি ছুটে যান। তাদের ভাষা শেখেন, তাদের সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করেন, তাদের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন, কেবলমাত্র ক্রিকেট প্রসারের স্বার্থে। কিভাবে ক্রিকেটটা তাদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা যায়, তা-ই নিয়ে দিনরাত খাটেন তিনি। আজ এখানে তো কাল ওখানে, যাযাবরের মতো জীবনটাকে উপভোগ করছেন, কেবল ক্রিকেট উপভোগ করেন তাই।
সন্তান-স্ত্রী থাকেন সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়। পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না তাদের। প্রাণের স্বদেশে কতবছর তাঁর ঈদ করা হয় না, আয়েশ করে কিছুদিন থাকা হয় না! আক্ষেপ আছে, তবে হতাশা নেই। তিনি তো এতসব ক্রিকেটের জন্যেই করছেন।
ক্রিকেটটাকে তাঁর মতো করে, এত আপন করে নিতে পেরেছে কে কবে!
‘এই যে চীন-কোরিয়ার স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে। সেখানে ক্রিকেটের সিডি-ডিভিডি পাঠাতে হয়। সেখানে আমি সবসময় চেষ্টা করি বাংলাদেশের জয়ের ভিডিও চিত্রগুলো পাঠাতে। এখন তাদের এমন একটি ধারণা হয়ে গেছে হয়তো, বিশ্বে বাংলাদেশ এমন একটি দল, যাদেরকে ক্রিকেটে কেউ কখনো হারাতে পারেনি।’
যেখানেই থাকুন দেশটাকে সবসময় অনুভব করেন তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের নেতিবাচক যে কোন আলোচনায়, সবচেয়ে শক্তিশালী উচ্চকিত স্বরটি হয় তাঁর। কোচিংয়ে এত ডিগ্রী নিয়েছেন, এত কিছু শিখেছেন, তাঁর স্বপ্ন একদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটেও সেসব ব্যবহারের সুযোগ পাবেন।
এতটুকুন শরীরের মানুষটি হৃদয়ে যেন এক পৃথিবী ভালোবাসা নিয়ে বসে আছেন। স্বদেশকে ঘিরে তাঁর কত স্বপ্ন, কত আশা। ‘একটা অন্যরকম স্বপ্ন দেখছি আমি। সেটা কারো কাছে আশ্চর্য্যের শোনালেও, বাংলাদেশের ৬০ হাজার প্রাথমিক স্কুলে ৬০ হাজার কোচ তৈরীর স্বপ্ন দেখি আমি। কোচিংয়ের আসল জায়গা সেখানেই। ক্রিকেটে ভালো করতে হলে স্কুল ক্রিকেটের শক্ত-মজবুত কাঠামো তৈরী করতে হবে।’ স্বপ্নের কথা জানিয়ে ছিলেন আমিনুল।
দেশের ষোলো কোটি মানুষ। লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশুর আছে। সবাই কি ক্রিকেটের সব সরঞ্জাম পেয়েছে? সবার জন্য কি পর্যাপ্ত ক্রিকেট সুবিধা আছে?
তিনি চান দেশের সমস্ত শিশু-কিশোরদের জন্য সব ধরণের ক্রিকেটীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে। স্বদেশে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ঘরোয়া অবকাঠামো তৈরীতে, নিজের সর্বোচ্চ জ্ঞান বিলিয়ে দিতে চান তিনি। চান নিজের আহরিত সবটুক ক্রিকেটজ্ঞান স্বদেশের জন্য উজার করে দিতে।
‘এই দেশ আমাকে অনেক অনেক কিছু দিয়েছে। কিছুটা হলেও তার প্রতিদান দেয়া আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি।’- এমন টনটনে কর্তব্য-জ্ঞান হয়তো তাঁর মতো স্বপ্নপুরুষের পক্ষ্যেই উপলব্ধি করা সম্ভব।