ব্যাটসম্যান হিসেবে কখনোই দলের সেরা ছিলেন না অ্যালিস্টেয়ার ক্যাম্পবেল। জিম্বাবুয়ের স্বর্ণযুগের সেরা ব্যাটসম্যানদের নাম করলে ফ্লাওয়ার ব্রাদারদের কথা আসবে, কেউ কেউ গাই হুইটাল বা নিল জনসনের প্রসঙ্গও আনবেন। তবে, ব্যাটসম্যানশিপে এদের চেয়ে খুব একটা পিছিয়েও ছিলেন না তিনি। আর যেদিকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিলেন, সেটাই তাকে নিয়ে গেছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের কাতারে। আর সেটা হল অধিনায়কত্ব।
ক্যাম্পবেল নি:সন্দেহে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক। ভারতের হয়ে টাইগার পতৌদি, শ্রীলঙ্কার হয়ে অর্জুনা রানাতুঙ্গা যে কাজটা করেছেন, ক্যাম্পবেল সেই একই কাজটা করে দিয়ে গেছেন জিম্বাবুয়ের হয়ে। নব্বই দশকের একটা সময় কিংবা তারও পরে কিছুদিন যে বিশ্বের সেরা সব দলের চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে পারত জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল, তার বড় একটা কারণ ছিলেন এই ক্যাম্পবেল।
ক্যাম্পবেলের জন্ম হারারে’র (তখনকার স্যালিসবুরি) এক ক্রিকেট পরিবারে, ১৯৭২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। ক্রিকেটে যোগ দেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল, কারণ বাবা ইয়াইন ছিলেন ক্রিকেট কোচ। তাদের নিজেদের একটা ক্রিকেট স্কুল আছে, লিলফোর্ডিয়া প্রাইমারি স্কুল। ক্যাম্পবেল সেখানেই ভর্তি হন। বাবার সাথে ছোট ভাই ডোনাল্ডের সাথে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন ক্যাম্পবেল। ডোনাল্ডের দৌঁড় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গিয়ে থেমেছে, আর ক্যাম্পবেল জিম্বাবুয়ের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা অধিনায়ক বনেছেন।
ক্যাম্পবেল শুরুতে ছিলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। তবে, বাবা ইয়াইন মনে করতেন, তার বড় ছেলের বাঁহাতে ব্যাট করা উচিৎ। বাবার সেই সিদ্ধান্তেই নিজেকে পাল্টে পুরোদস্তুর বাঁহাতি হলে গেছেন ক্যাম্পবেল। ইয়াইনের সেই সিদ্ধান্তের জন্য জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটেরই উচিৎ তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকটা সাদামাটা ছিল ক্যাম্পবেলের। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে, হারারেতে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন পাকিস্তান ‘বি’ দলের বিপক্ষে। দুই ইনিংসে করেছিলেন ২৯টি করে রান। যদিও, এই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই প্রথম আলোর বিচ্ছুরণ ঘটান ক্যাম্পবেল। তিনিই হলেন জিম্বাবুয়ের কনিষ্ঠতম ফার্স্ট ক্লাস সেঞ্চুরিয়ান। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে বুলাওয়েতে সফরকারী গ্ল্যামরগান দলের বিপক্ষে অপরাজিত ১০০ রান করেন, পরের ইনিংসে আবারও ৬৩।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
জিম্বাবুয়ে ক্যাম্পবেলকে ঘিরে বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ১৯৯২ বিশ্বকাপের দলে এই তরুণকে রাখা হয়। তবে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে সেবার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। চার ইনিংসে করেন মাত্র ১৩ রান।
তবে, ক্যাম্পবেলের টেস্ট অভিষেকটা মনে রাখার মত হয়েছিল। সেটা ছিল ১৯৯২ সালের অক্টোবর। মাত্র ২০ বছর বয়সে সফরকারী ভারতের বিপক্ষে ৩ নম্বরে খেলতে নেমেই করেন ৪৫ রান। ম্যাচটা ড্র হয়। ক্যাম্পবেল নয়, সেটা জিম্বাবুয়েরও প্রথম টেস্ট ছিল।
প্রথম ছয় টেস্টে পাঁচটা হাফ সেঞ্চুরি করে ফেললেও প্রথম ১৫টা ওয়ানডেতে কোনো বলার মতো স্কোর ছিল না ক্যাম্পবেলের। হারারেতে ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১১৫ বলে ১১টি চার ও চারটি ছক্কার সৌজন্যে পাওয়া ১৩১ রানের ইনিংসটা দিয়েই ক্যারিয়ারটাকে পাল্টে ফেলা শুরু করেন।
কালক্রমে টেস্টের চেয়ে ওয়ানডেতেই বেশি ধারাবাহিক হন তিনি। টেস্টে তার ১৮টি হাফসেঞ্চুরির পাশে সেঞ্চুরির সংখ্যা মাত্র দু’টি। অন্যদিকে, ওয়ানডেতে ৩০টি হাফ সেঞ্চুরির সাথে তিন অংকের ম্যাজিক্যাল ফিগার ছুঁয়েছেন সাতবার।
ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যাম্পবেলের সেরা সাফল্য আসে ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে পাকিস্তান সফরে। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস ও মুশতাক আহমেদদের সামলে সেবার টেস্ট সিরিজে ৪১ গড়ে করেন ২০৫ রান। পাঁচ ইনিংসে ছিল তিনটি হাফ সেঞ্চুরি।
এর ক’দিন বাদেই শুরু হয় ক্যাম্পবেলের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত সময়। ১৯৯৬ সালে তাকে অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাত্র তিন বছর তিনি দায়িত্বে ছিলেন। সেই তিনটা বছরই ছিল জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সবচেয়ে ভাল সময়।
১৯৯৮ সালে তার দল নিজেদের মাটিতে শক্তিশালী ভারতকে টেস্টে হারায়। এরপরের মাসেই পাকিস্তানে গিয়ে স্বাগতিকদের ১-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজে হারিয়ে আসেন ক্যাম্পবেলরা। এটা জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়।
ক্যাম্পবেল ও জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সুদিন অব্যাহত থাকে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপেও। সেই সময় ইংল্যান্ডে ‘ছোট দল’ হয়েই খেলতে গিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। কিন্তু, সবাইকে চমকে দিয়ে দলটি পৌঁছে যায় সুপার সিক্সে। হারায় ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে।
এর আগে ১৯৯৮ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। যদিও, তখন এই আসরের নাম ছিল আইসিসি নকআউট ট্রফি। স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল ‘মিনি বিশ্বকাপ’। সেই আসরের প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি করেছিলেন ক্যাম্পবেল। যদিও তাঁর অধিনায়কোচিত ইনিংসের পরও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে হেরে বিদায় নিয়েছিল জিম্বাবুয়ে।
বাংলাদেশের একটু সুখস্মৃতি ও একই সাথে দু:খস্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় ক্যাম্পবেলদের বিপক্ষেই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করেছিলেন মেহরাব হোসেন অপি। ১০১ রানের সেই ইনিংসটার পরও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ক্যম্পবেল একাই ৯৭ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলে ছিটকে দেন বাংলাদেশকে। ৫৮ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ফেলার পরও তিন বল বাকি থাকতে তিন উইকেটের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে সফরকারী জিম্বাবুয়ে দল।
টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে ক্যাম্পবেলের ক্যারিয়ারটা নি:সন্দেহে আরো জাকজমকপূর্ণ হতে পারতো। হয়নি, কারণ ইনিংসগুলোকে লম্বা করতে পারতেন না তিনি। অভিষেকের আট বছর পর গিয়ে আসে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। ২০০০ সালে সেবার যখন নাগপুরে ভারতের বিপক্ষে ৬১ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ইনিংস ব্যবধানে হারের শঙ্কায় ভুগছিল জিম্বাবুয়ে, তখন হাল ধরেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, সঙ্গী হিসেবে পান ক্যাম্পবেলকে। ফ্লাওয়ার ২৩২ রান করেন, আর ক্যাম্পবেল করেন ২০২। ম্যাচটা ড্র হয়।
এর আগে ১৯৯৪ সালেই অবশ্য হারারেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিলে ক্যাম্পবেল। কিন্তু, এক রান দূরে থাকতে আউট হন!
অধিনায়ক হিসেবে একটা বিশ্বকাপই খেলেছিলেন ক্যাম্পবেল। পরেরবার, মানে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের দলেই শুরুতে তার ঠাঁই হয়নি। নিজের দেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপ ভুলতে না পেরে অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। মার্ক ভারমিউলেনের ইনজুরির পর অবসর ভেঙে ফিরেছিলেন। বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের শেষ ম্যাচটা ক্যাম্পবেলের ক্যারিয়ারেরই শেষ ম্যাচ ছিল।
এরপর কখনোই জাতীয় দলের জন্য বিবেচিত হননি তিনি। ৬০টি টেস্ট আর ১৮৮টি ওয়ানডে ম্যাচের ক্যারিয়ার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ক্যাম্পবেলকে। অধিনায়ক ছিলেন ২১টি টেস্ট ও ৮৬টি ওয়ানডেতে।
এরপর অবশ্য বোর্ডে নানা পদে ছিলেন তিনি। ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়ের কোচ হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও ২০০৯ সালে আসেন প্রধান নির্বাচক হয়ে। লম্বা বিরতি দিয়ে ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ে যখন টেস্ট ক্রিকেটে ফিরেছিল, তখন দলটা নির্বাচন করে দিয়েছিলেন এই ক্যাম্পবেলই।
ক্যাম্পবেল আবারো পুরনো দিনের সতীর্থদের ফিরিয়ে এনেছিলেন। তার সময়েই কোচিং স্টাফ দলে দেখা গিয়েছিল হিথ স্ট্রিক, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারদের। ২০১৫ সালে ক্যাম্পবেল জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের (জেডসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান।
তবে, এই সময় অভিজ্ঞতাটা সুখকর ছিল না ক্যাম্পবেলের জন্য। সাবেক অধিনায়ক প্রসপার উৎসেয়া তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ আনেন। উৎসেয়ার দাবি ছিল, ক্যাম্পবেল সাদাদের বেশি সুযোগ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। উতসেয়া জেডসিকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে, কেবল কালো হওয়ার কারণেই ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাননি তিনি।
অভিযোগের ভিত্তিতে জেডসি চেয়েছিল, বোর্ডে ক্যাম্পবেলকে অন্য কোনো পদে দিতে। ক্যাম্পবেল সেই ঝামেলায় যাননি। তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর সারা বিশ্বব্যাপী ধারাভাষ্য দিয়ে বেড়ালেও কখনোই বোর্ডের সাথে জড়িত হননি ক্যাম্পবেল।
ক্যাম্পবেলদের ক্রিকেট খেলার সেই স্কুলটা আজও আছে। ক্যাম্পবেলের মা লেটিটিয়াই তার দেখাশোনা করেন। এই স্কুল থেকেই উঠে এসেছেন ব্রেন্ডন টেলর, ম্যালকম ওয়ালাররা। কে জানে, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এই দু:সময়ে আবারও হয়তো কোনো এক তারকার উপহার দেবে এই স্কুল!
অবসর নেওয়ার পর, দেশে থাকুন বা দেশের বাইরে, নিজেদের বাড়ির স্কুলটার সাথে সবসময়ই জড়িত ছিলেন ক্যাম্পবেল। মানে, ক্যারিয়ার শেষ করে ঠিক সেখানটাতেই তিনি ফিরেছেন, যেখান থেকে শুরু করেছিলেন তিনি!
প্রথম প্রকাশ: রোর বাংলা